বয়স তখন ১০-১২; তিন দিনের জ্বর ছেড়েছে সবে, দুপুরের খাওয়া সাঙ্গ করে একটু ঘুরতে বেরোলাম অনেকদিন পর। বেরিয়ে দেখি, আমাদের বাড়ির পাশের প্রকাণ্ড স্কুলমাঠ’টা নাকি দখল করেছে ভিনগাঁয়ের ‘পুতুলনাচ’। খুব আধুনিক সাজ নয় দেখলাম; বেশ অনেকটা এলাকা জুড়ে রঙিন তাঁবু টাঙ্গানো, গেটের মুখটাই কাপড়ের সুন্দর সুন্দর নকশা, আর তার পাশে একটা বোর্ডে লেখা কতগুলো নাটকের নাম—‘ভক্ত প্রহ্লাদ’, ‘সিতার বনবাস’, ‘কংসবধ’ ইত্যাদি। প্রবেশমূল্য ১০ টাকা লেখা দেখে পকেট হাতড়ে মাত্র ৫ টাকা পেলাম। বেশ নতুন ধরনের একটা আকর্ষণ, এদিকে ‘ভক্ত প্রহ্লাদ’ শুরু হতে মাত্র ৩ মিনিট বাকি; কিছু না ভেবে এক দৌড়ে বাড়ি গেলাম। প্রথমটাতে মা কে মানানো সোজা হোলোনা, তবে বেশ কিছুক্ষণ পর মা রাজি হয়ে গেলো। শো শুরু হওয়ার ৫ মিনিট মতো পরেই আমি ঢুকলাম।

তাঁবুর ভেতরটা অতটা বড়ো নয়। হাল্কা অন্ধকারে মাটিতে পাতা শতরঞ্চিতে বসে আছে ছেলে, মেয়ে, বউ মিশিয়ে বিশ-পঁচিশজন দর্শক, আর তার কিছুটা সামনে চারিপাশ রঙিন কাপড়ে সুন্দর করে ঘেরা ফুট দুয়েক উঁচু মঞ্চে চলছে পুতুলনাচ। আমিও এক ধারে একটু জায়গা করে বসলাম।

মঞ্চে এক এক করে বিভিন্ন চরিত্রে আলাদা আলাদা ভাবে সাজানো কাঠের পুতুলগুলো ঢুকছে। তাঁবুর ওপর থেকে বাধা কতগুলো সুতোর মাধ্যমে পুতুলগুলোর হাত, মাথা, মুখ নিয়ন্ত্রিতভাবে নাড়িয়ে অঙ্গভঙ্গি করানো হচ্ছে, পাশাপাশি তার নেপত্থ্যে চলছে বিভিন্ন চরিত্রের মুখের কথা; পরিস্থিতির গভীরতা অনুযায়ী বাজনা থেকে বের হয়ে আসা বিভিন্নরকম আওয়াজ। সবথেকে অবাক করার মতো ব্যাপার হোলো যে, মন দিয়ে দেখতে দেখতে একটা সময় পুতুলগুলোকে আর শুধু পুতুল বলে মনে হচ্ছিলনা। তারাই যেনো হাসছে, তারাই কাঁদছে, পুতুলগুলো সব যেনো জীবন্ত। কাঠের পুতুলগুলো দিয়ে এতো সুন্দরভাবে ‘ভক্ত প্রহ্লাদ’ এর নাটক’টা দেখে সত্যিই মুগ্ধ হওয়ার মতন।

সবশেষে পুরানোদিনের যাত্রাপালার মতো একটা পর্দা দিয়ে পুরো মঞ্ছ টা ঢেকে গেলো। তারপর তাঁবু থেকে বেরিয়ে আশেপাশে ঘোরার সময় বাইরে রাখা কাঠের পুতুলগুলোকে দেখে ওইটুকু বয়েসেও মুগ্ধ হয়ে গেছিলাম, শিল্পের এতো প্রকার ধরণ হয়!

বাংলার বিভিন্ন গ্রামে এখনো এমন বেশ কিছু পুতুলনাচ শিল্পীরা তাদের শিল্প নিয়ে বেঁচে আছে; তবে আধুনিক সমাজে থ্রিডি, ফোরডি, মাল্টিপ্লেক্স এর সাথে টক্করে তারা এঁটে উঠতে পারেনা। ২০০, ৫০০ টাকা টিকিটের ম্যাজিক শো এর বদলে ১০ টাকার ‘পুতুলনাচ’ কে কেও জায়গা ছেড়ে দিতে চায়না। ক্রমে হারিয়ে যাচ্ছে ছেলেবেলার সেই ‘পুতুলনাচ’, হয়তো ভবিষ্যতে কোনও একসময় তাঁকে পাওয়া যেতে পারে বাংলার ‘শিল্পের ইতিহাস’-এর পাতায়।

Atanu Chakraborty is a content and news writer at BongDunia. He has completed his Bachelor Degree on Mass Communication from Rabindra Bharati University. He has worked with mainstream media, in the capacity of a reporter and copywriter.

Leave A Reply