শারদীয় দুর্গোৎসব

সাধারণত আশ্বিন, কার্তিক মাসের শুল্ক পক্ষকে দেবী পক্ষ বলা হয়। দেবীপক্ষের আমবস্যায় মহালয়ার মাধ্যমে শুরু হয় শারদীয় দুর্গোৎসব । বাংলাদেশ, ভারত নেপালসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার সহিত এ উৎসব পালিত হয়।

সাধারণ ভাবে: বাংলাদেশে বারোয়ারী এবং পারিবারীক পুজা হয়ে থাকে। ধনী পরিবার গুলো থেকে পারিবারীক পুজা আয়োজন করা হয়ে থাকে। ভারত বর্ষে মূলত: বিট্রিশ বিরোধী আন্দোলনের জন্য মূলত: সার্বজনীন দূর্গা পুজা শুরু হয়। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুও পুজার সহিত যুক্ত থাকতেন।

শারদীয় দুর্গোৎসব বা শারদীয় দূর্গাপুজাকে ‘অকাল বোধন’ বলা হয়। হিন্দু শাস্ত্রীয় গ্রন্থ কালিকা পুরাণ ও বৃহদ্ধর্ম পুরাণে বলা হয় রাম ও রাবনের যুদ্ধের সময় শরৎকালে এ পুজা করা হয়। শাস্ত্র অনুসারে দেবতারা শরৎকালে ঘুমিয়ে থাকেন। এজন্য এ পুজার নাম অকাল বোধন। চৈত্র মাসে এ পুজার মত জগদ্ধার্থী পুজা অনুষ্ঠিত হয়। কৃতিবাস ওঝা রচিত রামায়নে রাম দূর্গা পূজার আয়োজন করেন।

ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে কৃষ্ণকে দূর্গাপূজার প্রবর্তক বলা হয়। এখানে বলা হয় সৃষ্টির প্রথমে কৃষ্ণ বৈকুন্ঠে প্রথম দূর্গাপুজা করেন। এরপর ব্রহ্মা মধু ও কৈটভ নামে দুই অসুর বধের জন্য দ্বিতীয় দুর্গাপূজা করেছিলেন। শিব ত্রিপুর নামে এক অসুরকে বধ করার তৃতীয় দুর্গাপূজার আয়োজন করেন। ইন্দ্র দুর্বাসা মুনির অভিশাপে লক্ষীকে হারিয়ে চতুর্থ দুর্গাপুজা করেন। ( শারদীয় দুর্গোৎসব ) 

এরপর থেকে মর্তলোকে দুর্গাপূজা করা হচ্ছে। শাক্তধর্মের ধর্মগ্রন্থ দেবীভাগবত পুরাণ বর্ণিত আছে ব্রহ্মার মানসপুত্র মনু ক্ষীরোদসাগরের তীরে দূর্গার মাটির মুর্তি তৈরী করে পূজা করেন। দেবী দুর্গা সন্তুষ্ট হয়ে মনুকে সন্তান লাভের বর দেন এবং তার রাজ্যশাসনের পথ পরিষ্কার করেন।

শ্রীশ্রীচন্ডী বা দেবীমাহাত্ম্যম-এ দুর্গা ও দুর্গাপুজাকে কেন্দ্র্র করে কয়েকটি পৌরানিক গল্প প্রচলিত আছে। প্রত্যেকটি গল্পে দুর্গাই কেন্দ্রীয় চরিত্র। গল্পগুলি রাজা সুরথের গল্প, মধুকৈটভের গল্প, মহিষাসুরের গল্প। এ তিনটি গল্পের মধ্যে মূলত: মহিষাসুর বধ কাহিনীটি জনপ্রিয়। এখানে মহিষাসুর যুদ্ধ করে দেবতাদের পরাজিত করে স্বর্গের অধিকার কেড়ে নেয়। বিষ্ণু, শিব এ কারণে ক্রোধান্বিত হলে তাদের মুখমন্ডল থেকে যে মহাতেজ নির্গত হয় তা হিমালয়ে ঋষি কাত্যায়নের আশ্রমে একত্রিত হয়ে নারীমূর্তির সৃষ্টি হয় যা কাত্যায়নী পূজা নামে অভিহিত হয়।

এ শাস্ত্র অনুসারে দেবীর বাহন সিংহ।দেবী ও তার বাহনের সাথে যুদ্ধ করে অসুর সেনারা পরাজিত হতে থাকে। শেষে মহিষাসুর বিভিন্ন রুপ নিয়ে দেবীর সাথে যুদ্ধ করতে থাকে একসময় সে মহিষরূপে দেবীর হাতে পরাস্থ হয়।

শারদীয় দুর্গোৎসব

দেবীমাহাত্মমে বর্ণিত শুম্ভ, নিশুম্ভের সহিত দেবীর দূর্গার যুদ্ধ হয়। বাল্মীকর রামায়নে রামের দূর্গাপুজার বিবরণ পাওয়া যায় না। কৃর্তিবাস রামায়নের অনুবাদের সময়ে এ কাহিনী সংযোগ করেন।

রামায়ন অনুসারে রাবন ছিলেন শিবভক্ত, শিব তাকে রক্ষা করতেন। ব্রহ্মার পরামর্শ রাম রাবন বধের জন্য দেবী দুর্গার পুজা করেন। রাম ১০৮টি নীল পদ্ম দিয়ে মহানবমী পুজার পরিকল্পনা করেন। দুর্গা রামকে পরীক্ষা করার জন্য একটি পদ্ম লুকিয়ে রাখেন। রাম পদ্ম না পেয়ে নিজের একটি চোখ নিবেদন করতে গেলে দুর্গা রামকে রাবন বধের বর দেন।

মহাভারতের বর্ণনা অনুযায়ী দুর্গা কালীর আরেক শক্তির নাম। দুই শক্তির আরাধনা ও মূর্তি কল্পনায় রয়েছে ব্যাপক অমিল। দুর্গা শিবের অর্ধাঙ্গিনী সে হিসাবে দেবী মাতা হিসাবে বিবেচিত হন। মারকেন্দ্রয় পুরান মতে চেদী রাজবংশের রাজা সুরথ খ্রীষ্ট্রের জন্মের ৩০০ বছর পূর্বে কলিঙ্গে দশেরা নামে দূর্গা পুজার প্রচলন করেন।

মধ্য যুগের বাংলা সাহিত্যে দুর্গা পুজার অস্তিত্ব দেখা যায়। ১১শ শতকে অভিনির্ণয়-এ, মৈথিলী কবি বিদ্যাপতির দুর্গা বন্দনা পাওয়া যায়। ১৫১০ সালে কুচ বংশের রাজা বিশ্ব সিংহ কুচবিহারে দুর্গা পুজার আয়োজন করেন।( শারদীয় দুর্গোৎসব )

কারো মতে, ১৫০০ খ্রীষ্টাব্দের শেষের দিকে দিনাজপুরের জমিদার প্রথম দূর্গা পূজা করেন। ১৬০৬ সালে নদিয়ার ভবনানন্দ মজুমদার দূর্গা পূজার প্রবর্তক। ১৬১০ সালে কলকাতার বারিশার সাবর্ন রায় চৌধুরী পরিবার সপরিবারে দুর্গা পুজার প্রচলন করেন। কারো মতে, ষোডশ শতকে রাজশাহী তাহেরপুর এলাকার রাজা কংশ নারাযন প্রথম দূর্গা পুজা করেন।

১৭১১ সালে অহম রাজ্যের রাজধানী রংপুরে শারদীয় পূজার নিমন্ত্রণ পেয়েছিলেন ত্রিপুরা রাজ্যের দূত রামেশ্বর নয়ালঙ্কার। নবাব সিরাজ-উদ-দ্দৌল্লার আক্রমনে কলকাতার একমাত্র চার্চ ধ্বংশ হবার পর সেখানে কোন উৎসব করা অবস্থা ছিল না। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের বিজয় লাভের পর কলকাতার শোভা বাজার রাজবাড়িতে রাজা নব কৃষ্ণদেব লর্ড ক্লাইভের সন্মানে দূর্গা পূজার মাধ্যমে বিজয় উৎসবের আযোজন করেছিলেন। ১৭৬১ সালে বার ইয়ার বা বারোয়ারী পূজা প্রথম হুগলীর গুপ্তিপাড়ার ১২ জন বন্ধু মিলে আয়োজন করেছিল।

আধুনিক দূর্গা পূজার প্রাথমিক ধাপ ১৮ম শতকে নানা বাদ্য যন্ত্র প্রয়োগে ব্যক্তিগত, বিশেষ করে জমিদার, বড় ব্যবসায়ী, রাজদরবারের রাজ কর্মচারী পর্যায়ে প্রচলন ছিল। পাটনাতে ১৮০৯ সালের দূর্গা তথ্য মেলে। ওরিষ্যার রামেশ্বরপুরে একই স্থানে ৪০০ শত বছর ধরে সম্রাট আকবরের আমল থেকে দূর্গা পূজা হয়ে আসছে। ১৯১০ সালে সনাতন ধর্মউৎসাহিনী সভা ভবানীপুরে বলরাম বসু ঘাট লেনে এবং একই জেলায় অন্যান্যরা রামধন মিত্র লেন, সিকদার বাগানে একই বছরে ঘটা করে প্রথম বারোয়ারী পুজার আয়োজন করে। ১৯২৬ সালে অতীন্দ্রনাথ বোস জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে পূজা উৎসবে অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।

ভারতের স্বাধীনতার সংগ্রামে দূর্গা পূজা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল । বৃটিশ বাংলায় এই পূজা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায়। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে দূর্গা স্বাধীনতার প্রতীক হিসাবে জাগ্রত হয়। বিংশ শতাব্দির প্রথমার্ধে এই পূজা ঐতিহ্যবাহী বারোয়ারী বা কমিউনিটি পূজা হিসাবে জনপ্রিয়তা লাভ করে। আর স্বাধীনতার পর এই পূজা পৃথিবীর অন্যতম প্রধান উৎসবের মর্যাদা পায়।

বিভিন্ন স্থানে দুর্গার ভিন্নতা দেখা যায়। বাকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর অঞ্চলে সপরিবার দুর্গার সহিত শিবের সঙ্গী নন্দী, ভৃঙ্গি ও বাহনসহ শিবের পুজা করা হয়। বর্তমানে দুর্গা পুজার সহিত হিন্দু শাস্ত্রের বিভিন্ন যুগের মূর্তির অবস্থানও দেখা যায়। বর্তমানে দুর্গা পুজার সাথে সামাজিক বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে থিম পুজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

বাংলাদেশের সাতক্ষীরার কলারোয়ার ১৮ শতকের মঠবাড়িয়ার নবরত্ন মন্দিরে ১৭৬৭ সালে দূর্গা পূজা হত বলে লোকমুখে শোনা যায় ইতিহাসবিদ দানীর মতে, প্রায় সাড়ে পাঁচশো বছর আগে রমনায় কালী মন্দির নির্মিত হয়েছিল এবং এখানেও কালী পূজার সাথে দূর্গা পূজাও হত।

শারদীয় দুর্গোৎসব

দূর্গা নামের মধ্যেও রয়েছে তাৎপর্য ‘দ’ অক্ষর দৈত্যনাশক, উ-কার বিঘ্ননাশক, ‘রেফ’ রোগনাশক, ‘গ’ অক্ষর পাপনাশক ও অ-কার ভয়-শত্রুনাশক। অর্থাৎ, দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ ও ভয়-শত্রুর হাত থেকে যিনি রক্ষা করেন, তিনিই দুর্গা। অন্যদিকে শব্দকল্পদ্রুম অনুসারে, “দুর্গং নাশযতি যা নিত্যং সা দুর্গা বা প্রকীর্তিতা” অর্থাৎ, দুর্গ নামক অসুরকে যিনি বধ করেন তিনিই নিত্য দুর্গা নামে অভিহিতা।

দুর্গা পুজায় মূলত যে সকল পর্ব থাকে তা মহালয়া, দুর্গাষষ্ঠী, কল্পারম্ভ, বোধন, আমন্ত্রন ও অধিবাস, সপ্তমীপূজা, নবপত্রিকা (নবপত্রিকা মূলত: নয়টি গাছের পাতা-কদলী বা রম্ভা (কলা), কচু, হরিদ্রা (হলুদ), জয়ন্তী, বিল্ব (বেল), দাড়িম্ব (দাড়িম), অশোক, মান, ধান), মহাস্নান (মহাস্নানের সময় শুদ্ধজল, নদীর জল, শঙ্খজল, গঙ্গাজল, উষ্ণ জল, সুগন্ধি জল, পঞ্চগব্য, কুশ ঘাসের দ্বারা ছেটানো জল, ফুলে দ্বারা ছেটানো জল, ফলের জল, মধু, দুধ, নারকেলের জল, আখের রস, তিল তেল, বিষ্ণু তেল, শিশিরের জল, রাজদ্বারের মাটি, চৌমাথার মাটি, বৃষশৃঙ্গমৃত্তিকা, গজদন্ত মৃত্তিকা, বেশ্যাদ্বারমৃত্তিকা, নদীর দুই তীরের মাটি, গঙ্গামাটি, সব তীর্থের মাটি, সাগরের জল, ঔষধি মেশানো জল, বৃষ্টিজল, সরস্বতী নদীর জল, পদ্মের রেণু মেশানো জল, ঝরনার জল ইত্যাদি দিয়ে দুর্গাকে স্নান করানো হয়), অষ্টিমি পূজা (অষ্টমির দিনে মূলত: কুমারী পূজা ও সন্ধি পুজা অনুষ্ঠিত হয়। কুমারী পুজায় ষোলো বছরের অরজঃম্বলা কুমারী মেয়ের পূজা করা হয়।

বর্তমানে কুমারী পূজার প্রচলন কমে গেছে, তবে রামক্ষ্ণৃ মিশনে কুমারী পূজার প্রচলন রয়েছে। প্রতিবছর দুর্গাপূজার মহাষ্টমী পূজার শেষে কুমারী পূজা অনুষ্ঠিত হয় তবে মতান্তরে নবমী পূজার দিনও এ পূজা অনুষ্ঠিত হতে পারে। দূর্গাপূজার একটি বিশেষ অংশ হল সন্ধিপূজা । অষ্টমী ও নবমী তিথির সংযোগ স্থলে এই পূজা হয় তাই এই পূজার নাম সন্ধিপূজা অর্থ্যাৎ সন্ধি-কালিন পূজা। এই পূজা দূর্গাপূজার একটি বিশেষ অঙ্গ, এইসময় দেবী দূর্গাকে চামুন্ডা রূপে পূজা করা হয়ে থাকে।

এই পূজা সম্পন্ন হয় তান্ত্রিক মতে। এই পূজায় দেবীকে ষোলটি উপাচার নিবেদন করা হয়, পশুবলি সেই বলিকৃত পশুর মাংস ও রক্ত এবং মদ প্রদান করা হয় দেবীর উদ্দেশ্যে। নবমীপূজা, দশমীপূজা, বিসর্জন ও বিজয়া দশমী, অপরাজিতা পূজা।

Mr. Shuva is a News and Content Writer at BongDunia. He has worked with various news agencies all over the world and currently, he is having an important role in our content writing team.

Leave A Reply