ক্যান্সার বা কর্কটরোগ যাকে অনেকে বলে থাকে ক্যান্সার হলে নাই এ্যানসার। আমাদের একটি ধারনা আছে ক্যান্সারের কোন চিকিৎসা নেই। এ রোগে মৃত্যু হার অনেক বেশি। প্রাথমিক অবস্থায় ক্যান্সার রোগ ধরা পড়ে না। শেষ পর্যায়ে ধরা পড়ায় এ রোগের চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হয় না। যে সব লক্ষন দেখে আমরা বুঝতে পারব ক্যান্সার রোগ হয়েছে তাই আমাদের আলোচ্য বিষয়। সত্যিকার অর্থে এখনও ক্যান্সারের কার্যকর ওষুধও আবিষ্কৃত হয়নি। ক্যান্সার প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পরলে সারানোর সম্ভবনা বেশী থাকে। ২০০ প্রকারের অধিক ক্যান্সার রয়েছে। প্রত্যেক ক্যান্সারেরই আলাদা চিকিৎসা পদ্ধতি রয়েছে।  অনেকের ধারনা ক্যান্সার একটি আধুনিক রোগ। আসলে এটা ঠিক নয়। প্রাচীন মিসর ও প্রাচীন গ্রিসের চিকিত্সরা ‘ক্যান্সারের’ উপসর্গ বর্ণনা করে গেছেন। এ ছাড়া, ৩ হাজার বছর আগের মানব জীবাশ্ম থেকে ক্যান্সারের লক্ষণ খুঁজে পেয়েছেন আধুনিক বিজ্ঞানীরা। হ্যাঁ, ক্যান্সার আধুনিক রোগ নয়, এর ইতিহাস মানবজাতির মতো সুদীর্ঘকালের। প্রাচীনকালে পরীক্ষা-নিরীক্ষার আধুনিক প্রযুক্তি ছিল না। অনেক তথ্য লিপিবদ্ধও হতো না। সমস্ত বিশ্বে ক্যান্সার একটি আতঙ্ক। এর কারণে ৪ ফেব্রুয়ারিকে বিশ্ব ক্যান্সার দিবস হিসাবে ঘোষণা করা হয়। (Symptoms Of Cancer In Bengali)

ক্যান্সার কি?

মানুষের শরীর অসংখ্য ছোট ছোট কোষের মাধ্যমে তৈরি হয়। এই কোষগুলো নির্দিষ্ট সময় পর পর মারা যায়। পুরনো কোষগুলোর জায়গায় নতুন কোষ জন্ম গ্রহণ করে। সাধারনভাবে কোষগুলো নিয়ন্ত্রিতভাবে এবং নিয়মমতো বিভাজিত হয়ে নতুন কোষের জন্ম দেয়। সাধারণত বলতে গেলে যখন এই কোষগুলো কোনও কারণে অনিয়ন্ত্রিতভাবে বাড়তে থাকে তখনই ত্বকের নিচে মাংসের দলা অথবা চাকা দেখা যায়। একে টিউমার বলে। এই টিউমার বিনাইন বা ম্যালিগন্যান্ট হতে পারে। ম্যালিগন্যান্ট টিউমারকেই ক্যান্সার বলে। অনিয়ন্ত্রিতভাবে বিভাজনক্ষম হয়ে বৃদ্ধি পাওয়া কোষকে নিওপ্লাসিয়া (টিউমার) বলে, এবং সেরকম ক্রিয়া যুক্ত কোষকে নিওপ্লাস্টিক কোষ বলে। নিওপ্লাস্টিক কোষ আশেপাশের কলাকে ভেদ করতে না পারলে তাকে বলে নিরীহ বা বিনাইন টিউমার। সহজে বলা যায় যে টিউমার বৃদ্ধি পায় না তাকে বিনাইন টিউমার বলে। বিনাইন টিউমার ক্যান্সার নয়। অনিয়ন্ত্রিত বিভাজনক্ষম ভেদক ক্ষমতাযুক্ত কোষগুলিকে ক্যান্সার কোষ বলে। যাকে ম্যালিগ্যান্ট টিউমার বা ক্যান্সার বলে। অনেক সময় বিনাইন টিউমার পরবর্তিত হয়ে ম্যালিগ্যান্ট টিউমারে পরিবর্তন হয়।

ক্যান্সারের কারণ

বংশগত: ক্যান্সার অনেক সময়ই বংশগত হতে পারে। তব সব ক্ষেত্রে নয়। পিতার ক্যান্স্যার হলে পুত্রের হবে এরকম কোন কারন নেই। তবে পরিবারে কেউ যদি ক্যান্সারে আক্রান্ত হন, তার পরবর্তীপ্রজন্মের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বাড়ে। মা স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হলে, মেয়েরও স্তন ক্যান্সার হতে পারে। এক্ষেত্রে আশঙ্কা তুলনামূলকভাবে বেশি। বিখ্যাত অভিনেত্রী অ্যাঞ্জেলিনা জোলির মা স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছিলেন। জোলি নিজেও এ ক্যান্সারের রোগী। তার দুটো স্তনই কেটে ফেলতে হয়েছে।

রাসায়নিক পদার্থ: রাসায়নিক পদার্থের সাথে ক্যান্সারের সম্পর্ক রয়েছে। বিশেষ করে জাহাজ তৈরির শিল্পের সাথে যারা জড়িত তাদের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে। রঙের কারখানা, রাবার বা গ্যাসের কাজে যারা নিয়োজিত তারা একধরনের বিশেষ রাসায়নিক পদার্থের সংস্পর্শে আসার কারণে মুত্রথলির ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। যার কারনে অনেক দেশে যে সকল রাসায়নিক ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায় তাদের নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-র ২০০৮ সালে প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুসারে, ক্যান্সারে আক্রান্তদের ১৯ শতাংশই বিরূপ পরিবেশের কারণে এ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। ক্যান্সারে প্রতিবছর ১৩ লাখ লোক প্রাণ হারান। হু’র আন্তর্জাতিক ক্যান্সার গবেষণালয় ১০৭টি বিপজ্জনক রাসায়নিক পদার্থ চিহ্নিত করেছে, যেগুলো মানবদেহে ক্যান্সার সৃষ্টি করতে পারে। এসবেস্টস, স্টিল কাস্টিং, অ্যালুমিনিয়াম, চামড়ার গুড়া ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।

পরিবেশ গত: ক্যান্সার অনেক সময় পরিবেশগত কারনে হয়ে থাকে। রোদে বেশিক্ষণ থাকলে ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে। এছাড়া ধূলা, বালিতেও ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।

জীবন যাপন: খাদ্যাভ্যাস এবং জীবনযাপন পদ্ধতির সাথেও ক্যান্সারের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। ধুমপান, মদ্যপানের সাথে ফুসফুস, মুখ ও কণ্ঠনালীর এবং যকৃত বা লিভারের ক্যান্সারের সম্পর্ক রয়েছে। তেমনিভাবে পান-সুপারি, জর্দা, মাংস, অতিরিক্ত লবণ, চিনি ইত্যাদি খাবারের সাথেও ক্যান্সারের যোগসূত্র রয়েছে। যারা সাধারণত শারীরিক পরিশ্রম কম করেন তাদের মধ্যেও ক্যান্সারের প্রবণতাটা বেশি।

বয়স: বয়স জনিত কারণে ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে। সাধারণত বয়স যত বাড়তে থাকে ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও তত বাড়তে থাকে। কারণ এ সময়ে শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা ধীরে ধীরে কমতে থাকে। এক হিসেবে দেখা যায় যত মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয় তাদের শতকরা ৭০ ভাগেরই বয়স ৬০ বছরের ওপর।

ক্যান্সারের লক্ষণ (Symptoms Of Cancer In Bengali)

যেসকল লক্ষণ দেখে বোঝা যায় ক্যান্সার, সেই লক্ষণ বা উপসর্গ গুলি নিম্নরুপ,

– দীর্ঘস্থায়ী ক্লান্তি বোধ করা

-আকস্মিক ওজন কমে যাওয়া

-দীর্ঘদিনের ব্যথা

-শরীরের যে কোন জায়গায় অস্বাভাবিক মাংসপিন্ড অর্থাৎ চাকা বা দলা দেখা দেওয়া

-ঘন ঘন জ্বর

-ত্বকের পরিবর্তন

-দীর্ঘস্থায়ী কাশি বা গলা ভাঙ্গা

-মল-মূত্রত্যাগে পরিবর্তন আসা (ডায়রিয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য কিংবা মলের সাথে রক্ত যাওয়া)

-অকারণে রক্তক্ষরণ

-খাবার গ্রহণে সমস্যা অর্থাৎ ক্ষুধা কমে যাওয়া

-জ্বর, রাতে ঠান্ডা লাগা বা ঘেমে যাওয়া

প্রস্রাবে পরিবর্তন

-মুখের পরিবর্তন

স্তনে পরিবর্তন

পাকস্থলি সংশ্লিষ্ট লক্ষণসমূহ

-অন্যান্য উপসর্গ-এর বাইরেও অনেক লক্ষণ আছে ক্যান্সারের পা ফুলে যাওয়া, শরীরের আকারে অস্বাভাবিক পরিবর্তন।

ক্যান্সার শনাক্তকরণ

ক্যান্সার শনাক্ত করার জন্য সবচেয়ে স্ক্রিনিং করা হয়। এছাড়া রক্ত পরীক্ষা, নি:শ্বাস পরীক্ষা। স্তন ক্যান্সারের জন্য রোগী নিজেই প্রাথমিক পরীক্ষা করতে পারেন। জরায়ু ক্যান্সারের ক্ষেত্রে পেপস স্মেয়ার টেস্ট বা প্যাপ স্মিয়ার টেস্ট, এজাতীয় ক্যান্সার সনাক্তকরণের একটি সহজ পরীক্ষা।

ক্যান্সার চিকিৎসা

ক্যান্সারের ধরন অনুযায়ী শল্যচিকিৎসা, রেডিওথেরাপি বা বিকিরণ চিকিৎসা, কেমোথেরাপি, হরমোন চিকিৎসা ও ইমিউনোথেরাপি, টারগেটেড থেরাপি ইত্যাদির মাধ্যমে সমন্বিতভাবে চিকিৎসা প্রদান করা যায়।

শল্যচিকিৎসা: স্তন, প্রস্টেট ক্যান্সারসহ কিছু চিকিৎসায় সার্জারি রোগীকে বেশি আরোগ্য করে। শরীরের অন্যান্য স্থানে ছড়িয়ে পড়া টিউমারের ক্ষেত্রে এর ভূমিকা অবশ্য নগণ্য।

রেডিওথেরাপি: অপারেশনের পরও খালি চোখে দেখা যায় না—এমন কিছু ক্যান্সার কোষের সহায়ক চিকিৎসা হিসেবে দেওয়া হয় রেডিওথেরাপি, বিশেষ করে এ রোগ মস্তিষ্ক বা হাড়ে ছড়িয়ে পড়লে জরুরিভাবে পেলিয়েশন বা প্রশমন করার জন্য রেডিওথেরাপির ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির মাধ্যমে রেডিওথেরাপি দেওয়া যায় বলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার আশঙ্কা খুবই কম থাকে।

কেমোথেরাপি ও হরমোন: ক্যান্সার রোগীর চিকিৎসায় কেমোথেরাপি ও হরমোনথেরাপি প্রয়োগ করা যায়। সামগ্রিকভাবে শরীরের সর্বত্রই এ রোগের বিরুদ্ধে কাজ করার জন্য এর ব্যবহার অপরিহার্য। দেখা গেছে, খুবই প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণীত হলে এবং যথোপযুক্ত চিকিৎসা নিলে ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ রোগী ১০ বছরেরও বেশি বেঁচে থাকে। মাঝ পর্যায়ে নির্ণীত হলে এই হার ৫০ থেকে ২৫ শতাংশে নেমে আসে এবং শেষ পর্যায়ে ভালো কিছু করার সুযোগ প্রায় থাকেই না।

ক্যান্সার কি ছোয়াচে?

ক্যান্সার কোন ছোয়াচে রোগ নয়। ক্যান্সার রোগীর সাথে একই থালায় খাবার খেলে বা এক গ্লাসে পানি খেলে ক্যান্সার ছড়াবে এরকম কোন তথ্য এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায় নাই।

কোন ব্যাক্তি ক্যান্সারের লক্ষণ দেখলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। সঠিক চিকিৎসা পদ্ধতিই আপনার আয়ুস্কাল বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। (Symptoms Of Cancer In Bengali)

Mr. Shuva is a News and Content Writer at BongDunia. He has worked with various news agencies all over the world and currently, he is having an important role in our content writing team.

Leave A Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.