চৌরাস্তার মোড়
এসকেএইচ সৌরভ হালদার

(লেখক পরিচিতিঃ- সৌরভ বাংলাদেশের একজন তরুণ লেখক । তিনি কবিতা লেখাতেই বেশী দক্ষ । কিন্তু তার লেখনী শুধুমাত্র কবিতায় সীমাবদ্ধ থাকেনি । ‘চৌরাস্তার মোড়’ গল্পটি লিখে তিনি প্রমান করতে পেরেছেন গল্পে বা উপন্যাসে তিনি কমতি নন । আশা করি এই গল্পটি পাঠকের সুবিচারে পড়বে । তার বয়স এখন মাত্র ১৭ । আগামী দিনগুলিতে তার শক্তিশালী লেখনী থেকে আরও ভালো ভালো লেখা পাঠককে মুগ্ধ করবে এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না ।

 

তখন শীতকাল বৃক্ষের পাতা ঝরে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। গায়ের চাদর মুড়িয়ে আমি তখন মেইন রোডের পাশ দিয়ে হেটে চলেছি।পাশ দিয়ে বিভিন্ন ধরনের গাড়ি চলছে রাতের বেলা গাড়ির আলো দূর থেকে বিভিন্ন রঙের সৃষ্টি হয়েছে খুব মনমুগ্ধকর একটি দৃশ্য।

চৌরাস্তার মোড়ে বট গাছের পাশে আমার বাড়ি।মঙ্গল ঘাট বলিয়া আমাদের ঐ বাড়ীটার নাম দিয়ে দিয়েছেন আমার দাদু আমল ঘোষ । আমি বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের একজন ছাত্র।বাংলা বিভাগের ছাত্র বলে নিজেকে একটু অন্যরকম ভাবি । কারণ বাংলা পড়িয়া অন্য লেখকদের যেরকম একটা অনুভব পায়, সেটা নিজের মধ্যে প্রকাশ করতে ইচ্ছে করে। কখন আমি নিজেকে কবি বলিয়া এবং কখনো সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ ভেবে থাকি।বই পড়তে আমার খুবই ভাল লাগে । কিন্তু বই পড়ার অভ্যাসটা একটু অন্যরকম আমার কাছে । কারণ আমি গভীর রাতে হাতে একটা কপি নিয়ে জানালার পাশে বই পড়ি প্রতিদিন।

প্রতিদিনের মতো আজও আমি বই পড়ছি জানালার পাশে বসে। হাতে এক কাপ কফি। হঠাৎ করে জানালার পাশ থেকে হিমের হাওয়ায় আমার শরীর শিঁউরে উঠলো। হঠাৎ কিছুক্ষণ পর আমার জানালার পাশ থেকে একটা শব্দ, যেটা কিনা অদ্ভুত আওয়াজ ।যেন ছিল থরথর করে কাঁপানোর আওয়াজ । যেটা শীতকালে সাধারণত হয়ে থাকে। আমি বাইরে আসতে চাইলাম তখনই । হঠাৎ করে বিদ্যুৎ চলে গেল। পাশে অন্ধকারে হাত ঠেকিয়ে মোমবাতি এবং দিয়াশলাই দিয়ে মোমবাতীটাকে জ্বালিয়ে বাইরে এসে দেখছি, কিন্তু শীতের হিমে প্রদীপ নিভু নিভু ভাব ‌‌।

আমি রাগ করে প্রদীপটা নিভিয়ে ল্যাম্পপোস্টের কাছে এলাম । কারন ল্যাম্পপোস্টের পাশে একটা বটগাছ, আর তার আড়ালে আমার কক্ষ। আমি কাউকে না দেখতে পেয়ে আমার কক্ষে চলে আসলাম তৎক্ষণাৎ । আবার সেই আওয়াজ শুনতে পেলাম ।তখন রাত বারোটা বাজে । নিজেকে বিভ্রান্ত মনে করিয়া আমি তখন আবার বই নিয়ে পড়তে যাচ্ছি এবং সেই সময় বিদ্যুৎ চলে আসলো।

তখন আরেকবার জানালার পাশে তাকিয়ে দেখি একটা বৃদ্ধ মহিলা। আমি বাইরে গিয়ে তাকে বললাম

-কে আপনি ? এখানে কি করছেন ?

কোন উত্তর পেলাম না । তখন তার হাতে হাত রেখে ডাকলাম, তখন বৃদ্ধ মহিলা নিম্নস্বরে বলে উঠলো

-কে তুমি বাবা?

আমি বললাম আমি অনুপম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্র । পাশে আমার কক্ষ,  আপনি এখানে কি করছেন ?

-কে আপনি? আপনার বাসা কোথায় ?

তখন উত্তর দিলো,  -আমি অঞ্জনা,  পাশের বস্তিতে থাকি।  আমি একটু জ্বর জ্বর বোধ  করছিলাম । তাই ডাক্তারের কাছে  যাচ্ছিলাম। এমন সময় মাথাটা ঘুরিয়ে নিয়ে এলো,  তাই একটু কাত হয়েছি।

বৃদ্ধ মহিলার কথা শুনে আমি তার মাথায় হাত দিয়ে দেখলাম তার শরীর অনেক গরম হয়ে আছে । কিন্তু আমি তার গায়ের চাদর কিংবা শীতবস্ত্র দেখতে পেলাম না ।

তখন আমি মহিলাকে হাত ধরে বললাম, – আমার সাথে আসুন ।

তখনই তিনি একটু কেসে বললেন,

-কোথায় যাব ?

আমি বললাম, – চলুন আমার রুমে । আপনার শরীরে অনেকটা জ্বর,  তার উপরে আপনার শরীরের শীতবস্ত্র নেই।

আমার রুমে এসে আমার কম্বলটা দিয়ে তাকে দিলাম এবং তার ওষুধের জন্য পাশে মনা কাকার দোকানে গেলাম । মনা কাকা এই রাস্তার মোড়ে একটা অন্যতম ওষুধের দোকান ।

মনা কাকাকে আমি বললাম, -মনা কাকা একটা জ্বরের ওষুধ দেন।

মনা কাকা বিস্মিত হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল । কারণ আমার পিতা-মাতা ব্যবসার কারণে অন্য জায়গায় থাকে । এখানে কারো জ্বর হয়েছে, এই কথা ভেবে সে একটু অবাক হল।

ফোনে কথা বললো,

– কার জ্বর হয়েছে ?

আমি অতিরিক্ত কোন বাক্য ব্যয় না করে,  দ্রুত ওষুধ এনে ওই বৃদ্ধা মহিলাকে খাইয়ে দিলাম এবং তার কাছে অতিরিক্ত কোন প্রশ্ন করলাম না । বৃদ্ধ মহিলাকে ওষুধ খাইয়ে পাশের চেয়ারে আমি বসলাম । হঠাৎ কোন সময় আমি ঘুমিয়ে পড়লাম আমি নিজেই বুঝতে পারলাম না।

পরদিন সকালে উঠে দেখি,সেই বৃদ্ধ মহিলাটি আমার কক্ষে নেই । তখন আমি চিন্তিত হয়ে খুঁজে দেখলাম । কিন্তু কোথাও খুঁজে পেলাম না । হঠাৎ করে কে এসে দরজাটা ঠকঠক করছে,  আমি দরজা খুলে দেখলাম পোস্টম্যান, আমার চিঠি এসেছে। চিঠিটা খুলে দেখে আমার মনটা ভরে গেল । আমি একটা কোম্পানিতে দরখাস্ত করছিলাম । সেখানে চাকরির জন্য আমারএকটি চিঠি এসেছে।

এমন সময় বাইরে থেকে কে যেন বলে উঠল

-বাবা অনুপম বাড়িতে আছো ?

তখন আমি বিস্মিত হয়ে দরজাটা খুললাম দেখি সেই বৃদ্ধ মহিলাটি।

– সকালে কোথায় ছিলেন ? আর আপনার হাতে ওটা কি ?

-বলব বলব আগে আমার একটু ভিতরে বসতে দাও।

– হ্যাঁ আসুন

– আমি সকালে আমার বাড়িতে গিয়েছিলাম

আমি বলে উঠলাম, – ওই বস্তিতে,

-হুম

-আমি সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি তুমি কেদারার উপরে  ঘুমাচ্ছো,  তাই আর ডাকেনি। আমার ওই বস্তিতে এক পাতানো মেয়ে আছে । সেই আমাকে দেখাশোনা করে ।তাই ওকে তোমার কথা বলছি। তুমি না থাকলে তো আমি কাল মারা যেতাম ।আমার ঐ বস্তির পাশে একটা জলপাই গাছ আছে । তাই তোমার জন্য জলপাই নিয়ে এসেছি।

-ও আচ্ছা? কাল রাতে আপনি অসুস্থ থাকায় আপনার কাছে আমি কিছু জিজ্ঞাসা করতে পারিনি । আপনি এই বস্তিতে থাকেন কেন ? আপনার স্বামী ছেলেমেয়ে নেই?

তখন দুঃখের সাথে বলে উঠল,  -আমার এই পৃথিবীতে কেউ নেই ।

আমি তখন বললাম -সেটা আবার হয় নাকি ?

তখন বৃদ্ধ মহিলা বললো,  -আমার স্বামী ছিল একজন সাধারন মানুষ । জায়গা জমি ছিল, আর  আমার একটা ছেলে ।  স্বামী মারা যাওয়ার কয়েক মাস পর আমি আমার ছেলেকে বিয়ে দিই ,তারপর ছেলে আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয় ।  এরপর থেকে আমি বস্তিতে থাকি । ছেলে নতুন বিবাহ করে তার  স্ত্রী-পুত্র নিয়ে সুখে-শান্তিতে আছে ।

একটু চুপ থাকার পর আবার বলল,  -আর আমি এখন কাজ করে খেতে পারি না । কারণ আমি এখন বুড়ো হয়ে গেছি।হঠাৎ কিছুদিন আগে আমার কুসুম এর সাথে পরিচিত হয় । তারপর থেকে ও কাজ করে এবং আমাকে দেখাশুনা করে।

বৃদ্ধমহিলাটির কথা শুনে আমার মন দুঃখের সঙ্গে কেঁদে উঠলো । তারপর আমার চাকরি হওয়ার কারণে আমি বৃদ্ধ মহিলাকে আনন্দের সাথে বললাম,

– আমার একটা কোম্পানিতে চাকরি হয়েছে ।

তখন বৃদ্ধ মহিলা রহস্য করে আমাকে বলতে লাগলো,  -আমাকে কিন্তু একটা ভালো শাড়ি কিনে দিতে হবে।

তখন আমি বললাম,

– হ্যা দেব

পরের দিন সকালে আমি ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিচ্ছি । বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় দেখি ওই বৃদ্ধ মহিলা লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে আছে একটু দূরে  এবং তার হাতে একটা প্যাকেট আছে এবং সে আমাকে ডেকে বলল —-বাবা অনুপম

– হ্যাঁ

– এই নে তোর জন্য একটু পায়েস তৈরি করে নিয়ে আসলাম । তুই ঢাকায় যাচ্ছিস । যাওয়ার সময় ক্ষুধার্ত হলে এটা খেয়ে নিস ।

তখন আমি নিরবে বলে উঠলাম,  -আপনি এইভাবে আমার জন্য কেন কষ্ট করছেন?

-ও তুই বুঝবি না ।

আমি বৃদ্ধ মহিলাকে প্রণাম করে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম । দীর্ঘ এক মাস পর ছুটিতে বাড়ি যাচ্ছি । এমন সময় বৃদ্ধ মহিলার কথা মনে পরল । তখন আমি দোকান থেকে একটা শাড়ি কিনে নিয়ে এলাম।  তারপর বাড়ি ফিরে রানু কাকাকে দিয়ে ওই বৃদ্ধ মহিলার খবর দিতে বললাম। রানু কাকা আমার বাড়িতে রান্না করে ।

রানু কাকা বলল অনুপম ওই বৃদ্ধ মহিলাটি তোমার কথা অনেক বলছিল । সে এখন অসুস্থ হয়ে তার বাড়িতে পড়ে ছিলো অনেকদিন ।  টাকা না থাকায় ওষুধ না খেয়ে সে মারা গেল এবং তোমাকে দেখার জন্য সে অনেক ‘অনুপম’ ‘অনুপম’ বলে ডাকছিল। কিন্তু তার আর দেখা হয়ে উঠল না।

এই কথা শুনে আমার মনটা দুঃখে হা হা করে উঠলো। তৎক্ষণাৎ আমি বট গাছের নিচে বসে পড়লাম । তারপর বৃদ্ধ মহিলার কথা মনে পড়ে আমার খুব খারাপ লাগছিল।তারপর থেকে সেই গভীর রাতে এক কাপ কফি নিয়ে বই পড়ার অভ্যাস টা আর রইল না । এখনো আমি ওই চৌরাস্তার মাঝে তাকিয়ে থাকি এবং ওইখানে আমি যেন আটকে আছি এক নিরবতার মাঝে কল্পনার চোখে দেখতে পাই বৃদ্ধ মহিলাকে চৌরাস্তার মোড়ে।

Kajal Paul is one of the Co-Founder and writer at BongDunia. He has previously worked with some publishers and also with some organizations. He has completed Graduation on Political Science from Calcutta University and also has experience in News Media Industry.

Leave A Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.