বিশ্ব ঐতিহ্যের শহর বাগেরহাট সদর উপজেলার যাত্রাপুর এর বারুইপাড়া ইউনিয়নের অযোধ্যা গ্রামে অযোধ্যার মঠ বা কোদলার মঠ অবস্থিত। এ মঠের নাম কোদলা মঠ হলেও স্থানীয় ভাবে অযোধ্যা মঠ নামে পরিচিত। অযোধ্যার মঠ বা কোদলার মঠ ভৈরব নদীর পূর্ব তীরে অবস্থিত। স্থানীয় ভাবে, বই পুস্তক ও বিভিন্ন লেখা প্রকাশনায় অযোধ্যার মঠ বা কোদলার মঠ দুটি নামই দেখা যায়। অযোধ্যার মঠ বা কোদলার মঠ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তালিকাধিন একটি স্থাপনা।
অযোধ্যা বা কোদলার মঠের আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে এর চার পাশে স্থাপত্যর অলঙ্করণ করা অপূর্ব কারুকাজ । বর্গাকার চতুস্কোণ বিশিষ্ট ভিতের উপর নির্মিত হয়েছে অযোধ্যা বা কোদলার মঠটি। উচ্চতা আনুমানিক ১৮.২৯ মিটার। প্রাচীরগুলি চিকন ইটের তৈরি, পুরুত্ব ৩.১৭ মিটার। ভেতরের প্রত্যেক দেয়াল বর্গাকার, দৈর্ঘ্য ২.৬১ মিটার। দেয়ালের ইট লাল পালিশ করা।
অযোধ্যা বা কোদলার মঠের প্রবেশ পথ ৩টি। পূর্ব, পশ্চিম ও দক্ষিনে এ প্রবেশ পথগুলি। ধারণা করা হয় দক্ষিণ দিকের পথটি মূল প্রবেশ পথ। দক্ষিণ দিকের প্রবেশ পথের উপরে আদি বাংলায় মঠটির সম্পর্কে খোদাই করা রয়েছে। উড়িষ্যা অঞ্চলে খ্রীষ্টীয় ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত যে ‘রেখা’ নমুনার মন্দির নির্মাণ পদ্ধতি দেখা যায় তার প্রভাব এ মঠে আছে বলে ধারণা করা হয়। অযোধ্যার মঠ বা কোদলার মঠ কোন দেব মন্দির নয়, সম্ভবত: মৃত: মহাত্মার সমাধি সম্ভ।
দক্ষিণ দিকের প্রবেশ পথের উপর দুই লাইনের ইটের খোদাই করা লেখা ছিল। প্রথম লাইনের অক্ষরগুলোর পাঠোদ্বারের পূর্বেই ভেঙ্গে যায়। স্থানীয় ইতিহাস গ্রন্থ থেকে জানা যায় লেখাটি ছিল
“————– শর্মনা।
উদ্দিশ্য তারকং(ব্রক্ষ্ম) [প্রশা] দোহাং বিনির্মিত:।।”
সংক্ষিপ্ত ও খন্ডলিপিটির সঠিক অর্থ সঠিক ভাবে নিরুপন করা না গেলেও যতদূর পাঠোদ্বার করা যায়, তা থেকে অনুমান করা হয় “তারকের (জনৈক ব্রাক্ষণ কার্তিক) প্রাসাদ বা অনুগ্রত লাভের জন্য এ মঠটি সম্ভবত একজন ব্রাহ্মণ (শর্মনা) কর্তৃক নির্মিত হয়েছিল। মঠের নির্মান নিয়ে যে সকল তথ্য জানা যায় এবং সবচেয়ে বেশী স্বীকৃত সেটি হল, বারভূইয়ার অন্যতম রাজা প্রতাপাদিত্যের উদ্যেগে তার গুরু (সভাপন্ডিত) অবিলম্ব স্বরস্বতীর স্মতিস্তম্ভ হিসাবে মঠটি নির্মান করা হয়।
রাজা প্রতাপাদ্যিতের শাসনামল থেকে জানা যায়, সে সময় সমগ্র বাগেরহাট প্রতাপাদিত্যের শাসনাধীন ছিল। বিশেষ করে প্রতাপাদিত্যের কাকা বসন্ত রায়ের মৃত্যুর পরে (প্রতাপাদিত্য তার কাকাকে হত্যা করে) বলেশ্বর নদী পর্যন্ত তাঁর শাসন ব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল।
কথিত আছে, প্রতাপাদিত্য তাঁর নিজের কাকা বা জামাইকে হত্যার চেষ্টা করলেও তাঁর শাসনে অবস্থিত বহু পন্ডিতকে বৃত্তি দিতেন। প্রতাপাদিত্য নিজে শিক্ষিত ছিলেন এবং যোগ্য ব্যাক্তিরা তাঁর কাছে যোগ্য সমাদর পেতেন । সভাপন্ডিতদের মধ্যে অন্যতম প্রতাপাদিত্যর বন্ধুকবি অবিলম্ভ স্বরস্বতী। তিনি মুখে মুখে দ্রুত কবিতা রচনা করতে পারতেন বলে তার নাম অবিলম্ব স্বরস্বতী হয়েছিল। এই অবিলম্ভ স্বরস্বতীর ভাই ছিলেন ডিম ডিম স্বরস্বতী। তিনি মুখে মুখে কবিতা রচনা করতে পারতেন না বলে তার নাম হয়েছিল ডিম ডিম স্বরস্বতী।
মঠের বাইরের দিকের প্রত্যেক পার্শ্ব দেয়াল বহুভূজ এবং পাঁচটি করে কুলুঙ্গি রয়েছে। বাইরের দিকের সম্মুখ ভাগের প্রত্যেক অংশে ছয়টি সমতল এবং এগারোটি কুলুঙ্গি দ্বারা সৃষ্টি করা হয়েছে বহুভূজ আকৃতির এই পাঁচটি কুলুঙ্গি। বাইরের দেয়ালের ডিজাইনে নিচ থেকে উপরের দিকে ক্রমান্বয়ে চক্রাকারে বলয় তৈরি করে উঁচুতে সরল অনুভূমিক রেখা সৃষ্টি করে উঠে গিয়েছে। কোদলা মঠের বহির্ভাগের এ অলংকরণই মন্দিরের প্রধান আকর্ষণীয় স্থান। পিরামিডের অনুরূপ উঁচু স্থাপত্যিক গঠনই একে শিখর স্টাইলের সঙ্গে অঙ্গীভূত করেছে। মঠের ভেতরের অংশে ১২/১৩ ফুট পর্যন্ত লম্বা গুম্বুজ ফাঁকা তলদেশর আকারে উপরে উঠে গিয়ে শেষ হয়েছে। অনেকে ধারণা করে এর উপরেও মঠের অভ্যন্তরে শূন্য/ফাপা আছে।
আজ রক্ষনাবেক্ষনের অভাবে এই ঐতিয্যময় স্থাপনা ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাচ্ছে ।