সময়ের সাথে হাত মিলিয়ে

ভাষা আন্দোলনের ইতিকথা (২১শে ফেব্রুয়ারি) – Bhasha Andolon

বাঙালী জাতি বলতে গেলে পৃথিবীর সর্বত্র বিরাজমান। প্রাচীনকালের ইতিহাস একটু ঘাটলে দেখা যাবে। প্রাচীনকালে ভারতের পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন জাতি (কলিঙ্গ, তামিল, বাঙালী), দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ায় নানা  উপনিবেশ গড়ে তুলেছিল। ভিয়েতনামী ইতিহাস থেকে জানা যায়, ভারতবর্ষের ‘বন-লাং’ নামক দেশ থেকে ‘লাক লং’(খুব সম্ভবত লক্ষন) নামক এক ব্যাক্তি ভিয়েতনামে গিয়ে ‘বন-লাং’ নামক একটি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। এই ‘বন-লাং’ যে ভারতের ‘বাংলা’, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহের অবকাশ রাখেনা।

 

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অবসানের পর ভারতবর্ষ ভেঙে দু’টুকরো হয়ে যায়, ভারতপাকিস্তান। পাকিস্তানের আবার দুটি ভাগ হয় ভাষার ওপর ভিত্তি করে, একটি পশ্চিম পাকিস্তান(বর্তমান পাকিস্তান, যার ভাষা উর্দু), অপর’টি পূর্ব পাকিস্তান (অধুনা বাংলাদেশ, যার ভাষা বাংলা)। আমাদের আলোচনার মুল প্রতিপাদ্য বাংলা ভাষা আন্দোলন (Bhasha Andolon)। এটি মুলত ছিল একটি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন, এটি তৎকালীন পূর্ব বাংলায় ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৫৬ সাল  পর্যন্ত ছিল।

বাংলা ভাষা আন্দোলন (Bhasha Andolon)

একটি জাতির মৌলিক অধিকার’গুলির মধ্যে অন্যতম হলও তার মায়ের ভাষা মাতৃভাষা। এই মৌলিক অধিকার দাবীর উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে বাংলা ভাষা আন্দোলন ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি এই আন্দোলন চূড়ান্ত আকার ধারণ করলেও এর সুত্রপাত হয়েছিল অনেক আগেই। তদানীন্তন পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে কেবলমাত্র ভৌগোলিক দূরত্ব ২,০০০ কিলোমিটার ছিলনা, ভাষাগত ও অন্যান্য অনেক’গুলি মৌলিক পার্থক্য বিরাজমান ছিল। একটা সময়, ক্ষমতাশালী পশ্চিম পাকিস্তান ১৯৪৮ সালে ঘোষণা করে, একমাত্র উর্দু’ই হবে দুই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। স্বভাবতই পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসকারী বাংলাভাষী বাঙালী জাতি এই আকস্মিক সিদ্ধান্ত মানসিকভাবে মেনে নিতে পারেনি। ফলস্বরূপ বাংলা ভাষার সমান অধিকারের দাবি উঠে আসে এবং বাংলা ভাষা আন্দোলন দ্রুত দানা বাঁধতে শুরু করে। সেই সময়ে সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে পূর্ব পাকিস্তান তথা অধুনা বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরে কোনও রকম মিটিং, মিছিল বা জনসমাবেশ নিষিদ্ধ করেন।

১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি জনগণ সরকারী আদেশ অমান্য করে। ঢাকা শহরের প্রগতিশীল, শিক্ষিত সমাজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্র-ছাত্রী’রা এবং রাজনৈতিক কর্মীরা মিলে বিশাল মিছিল বের করেন। পুলিশ ১৪৪ ধারা অবমাননা করার অজুহাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ এর কাছাকাছি মিছিল’টির ওপর এলোপাথারি গুলিবর্ষণ ও লাঠি চার্জ শুরু করে। তেজোদিপ্ত তরুণ সালাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের  মেধাবী ছাত্র বরকত, ধনী পরিবারের সন্তান রফিক সহ বহু শহীদের পবিত্র লাল রক্তে রঞ্জিত হয়ে ওঠে ঢাকার রাজপথ।

শিক্ষক-ছাত্র সমাবেশ

শোকাবহ এই ঘটনা মুহূর্তের মধ্যে সাড়া বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। অশান্ত বাংলাদেশের দামাল সন্তানেরা ছাড়াও ছাত্র, শ্রমিক, বুদ্ধিজীবী সহ সকল স্তরের মানুষ রাস্তায় নেমে পড়ে। এই সকল মিছিলের আন্দোলনকারীদের ওপর নির্লজ্জ পুলিশি হামলা ও অত্যাচার চলতে থাকে। ২১শে ফেব্রুয়ারি‘র বীরত্ব’কে অমর করে রাখার জন্য রাতারাতি মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গনে গড়ে তোলা হয় শহীদমিনার২৪ তারিখে শহীদমিনারের উদ্বোধন করেন বীর শহীদ শফিউর রহমানের পিতা

ক্রমবর্ধমান অদম্য আন্দোলন রুখতে না পেরে, ১৯৫৬ সালে সংবিধান পরিবর্তন করে বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা বাংলা করে দেওয়া হয়।

মাতৃভাষা উদ্ধার করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের শত শত তরুণ বিপ্লবী’দের বলিদানের বীরত্বের কারনে ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো মান বই‘য়ে বাংলা ভাষা আন্দোলনের পরিচয় হয় আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস হিসেবে।

“আমার ভাই’য়ের রক্তে রাঙানো ২১শে ফেব্রুয়ারি,
আমি কি ভুলিতে পারি?”
মন্তব্য
Loading...