বাংলাদেশের হিন্দু মন্দির
হিন্দু বা সনাতনী ধর্মের জন সংখ্যার বিচারে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম দেশ বাংলাদেশ । ভারত ও নেপালের পর বাংলাদেশে সর্বাধিক বেশী সংখ্যক সনাতন ধর্মাবলম্বী মানুষের বসবাস । দেশভাগ ও জাতিগত বিদ্বেষ এর কারণে দিন কে দিন বাংলাদেশি হিন্দু জনসংখ্যা কমে গেলেও এখনো বাংলাদেশে অনেক প্রাচীন ও হিন্দু মন্দির রয়ে গেছে । তবে মুসলিম আধিপত্যর কারণে এবং বিধর্মী মানুষের জমি সংক্রান্ত লোভের কারণে হিন্দু মন্দির গুলোর অধিকাংশ জমি বেদখল হয়ে গেছে । বিভিন্ন প্রতিকূলতা থাকলেও এখনও বাংলাদেশের মন্দির, আশ্রম বা আখড়ার সংখ্যা এক লাখের উপরে
বাংলাদেশের শীর্ষ দশটি হিন্দু মন্দির সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা হল –
১) সৎসঙ্গ আশ্রম পাবনাঃ-
দশম তালিকায় থাকা পাবনা শহরের নিকটে হেমায়েতপুর গ্রামের সৎসঙ্গ আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব শ্রী শ্রী ঠাকুর অনুকূল চন্দ্রের সৎসঙ্গ আশ্রম । ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র ১৮৮৮ সালের ১৪ ই সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ ভারতের বাংলাদেশের পাবনা জেলার রায়পুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন । শ্রী শ্রী ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র স্বাস্থ্যগত কারণে দেশভাগের আগে ভারতের দেওঘরে চলে আসেন এবং পরে তিনি আর বাংলাদেশে ফেরেনি । ১৯৪৭ সালের পর পাকিস্তান সরকার মানসিক হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার জন্য সৎসঙ্গ আশ্রমের জমি অধিগ্রহণ করে এবং মানসিক হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করে । স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের ভক্তরা নতুন উদ্যোমে আবার সৎ সংঘ প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ শুরু করেন । বর্তমানে এখানে ঠাকুর অনুকূল চন্দ্রের একটি মন্দির রয়েছে । সৎসঙ্গ আশ্রম টিতে কোনো উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়নি । মন্দিরের পাশে শ্রী শ্রী ঠাকুর অনুকূল চন্দ্রের পূজার ঘর অবস্থিত । এখানে শ্রী শ্রী অনুকূল চন্দ্রের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী কে কেন্দ্র করে বিরাট অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় । প্রতিবছর ভাদ্র মাসের তাল নবমী তিথিতে ঠাকুরের জন্মতিথি উপলক্ষে স্নান যাত্রার আয়োজন করা হয় । ওই সময় এখানে কয়েক লক্ষ পুণ্যার্থীর সমাগম হয় । প্রচুর ভারতীয় প্রতিবছর এই মন্দির দর্শন করেন ।
২) চৈতন্য মন্দির গোলাপগঞ্জঃ- বাংলাদেশের হিন্দু মন্দির
নবম তালিকায় থাকা বাংলাদেশের ঢাকা শহরের গোলাপগঞ্জ জেলার দক্ষিণ ইউনিয়নে অবস্থিত এই বিখ্যাত চৈতন্য মন্দির, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম ঐতিহাসিক তীর্থস্থান । ভারতীয় উপমহাদেশের বৈষ্ণব ধর্মের প্রবর্তক চৈতন্য দেবের পৈত্রিক নিবাস এটি ।চৈতন্য দেবের পিতা মাতার পৈতৃক বাড়ি ছিল এখানে । পিতা শ্রী জগন্নাথ মিশ্র এবং মাতা শচী দেবী বসবাস করতেন এখানে । বিবাহের কিছুদিন পর চৈতন্য দেবের মাতা গর্ভবতী হলে তার দিদিমা স্বপ্নে দেখেন যে, এই সন্তান হচ্ছেন স্বয়ং ভগবান । তবে সন্তান ভূমিষ্ঠ হয় অন্য জায়গায় । দিদিমার ইচ্ছানুসারে শ্রীচৈতন্যদেব একবার ঢাকায় এসেছিলেন তাঁর পিতার জন্ম ভিটা দেখতে । প্রতি বছর চৈত্র মাসে এখানে উৎসবের আয়োজন করা হয় । সারা মাস ব্যাপী চলমান এই উৎসবে মেলা, সং কীর্তন, পূজা প্রভৃতির ব্যবস্থা করা হয় ।
৩) রমনা কালী মন্দির, ঢাকাঃ- বাংলাদেশের হিন্দু মন্দির
অষ্টম তালিকায় থাকা রমনা কালী মন্দির ভারতীয় উপমহাদেশের বিখ্যাত হিন্দু মন্দির সমূহের মধ্যে অন্যতম ছিল । এটি রমনা কালী বাড়ি নামেও পরিচিত । এই প্রাচীন মন্দির প্রায় এক হাজার বছরের পুরাতন বলে বিশ্বাস করা হয় । তবে ইংরেজ আমলে এই মন্দিরটি আবার নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছিল । বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বহির্ভাগে এই মন্দিরটি অবস্থিত । ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হানাদারা রমনা কালী মন্দির ধ্বংস করে ফেলে ।
৪) কাল ভৈরব মন্দির ব্রাহ্মণবাড়িয়াঃ- বাংলাদেশের হিন্দু মন্দির
সপ্তম তালিকায় থাকা বাংলাদেশের বিখ্যাত কালভৈরব মন্দির, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক এবং গুরুত্বপূর্ণ মন্দির । তিতাস নদীর কূল ঘেঁষে অবস্থিত কালভৈরব একটি ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যবাহী মন্দির হিসেবে বিখ্যাত । মন্দিরের প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে কাল ভৈরব বিগ্রহ – যার উচ্চতা ২৮ ফুট । এই বিশাল উচ্চতা বিশিষ্ট বিগ্রহটি ১৯০৫ সালে তৈরি করা হয় । স্বাভাবিকভাবে প্রথম দর্শনে যে কেউ ভয় পেয়ে যেতে পারেন এই বিরাট আকারের মূর্তি দেখে । এই বিগ্রহের ডান পাশে রয়েছে একটি কালী মূর্তি এবং বাম পাশে পার্বতী দেবীর মূর্তি । বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কাল ভৈরবের বিগ্রহটি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নজরে এলে, তারা ডিনামাইটের আঘাতে শিব ও পার্বতীর অনেকাংশে ক্ষতিগ্রস্ত করে ।
৫) শ্রী শ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারীর আশ্রম বারদীঃ- বাংলাদেশের হিন্দু মন্দির
ষষ্ঠ তালিকায় থাকা ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁ উপজেলার বারদিতে বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর আশ্রম অবস্থিত । বাবা লোকনাথের জীবনী থেকে আমরা দেখতে পাই, বারদিতে অবস্থানকালীন বাবা লোকনাথের অলৌকিক সত্তার পরিচয় চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে । বারদিতে গড়ে ওঠে বাবা লোকনাথের মন্দিরে লোকনাথের জন্ম তিথি উপলক্ষে প্রতিবছর মেলা বসে । উৎসবে অংশগ্রহণ করতে প্রতিবেশী দেশ ভারত, নেপাল, ভুটান, শ্রীলংকাসহ বিভিন্ন দেশের লক্ষাধিক মানুষ লোকনাথ ব্রহ্মচারীর বারদী আশ্রমে এসে সমবেত হয় ।
৬)পুঠিয়া মন্দির চত্বরঃ–
পঞ্চম তালিকায় থাকা বাংলাদেশের রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পুরনো হিন্দু মন্দির নিয়ে পুঠিয়া মন্দির চত্বর অবস্থিত । রাজশাহী শহরের ২৩ কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত এখানে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ঐতিহাসিক মন্দির রয়েছে । রাজশাহীর বিখ্যাত জনহিতৈষী রাজপরিবারের হিন্দু রাজারা এই মন্দির গুলো প্রতিষ্ঠিা করে ছিলেন । মন্দিরগুলোর বেশ কয়েকটি টেরাকোটা সম্বলিত এবং এগুলোর স্থাপত্য চোল- বাংলা স্থাপত্য রীতির মিশ্রণ ঘটেছে । পুঠিয়ার রাজবাড়িতে ইন্দুস আর্সেনিক স্থাপত্য রীতি অনুসারে নির্মিত একটি জলাধারের চারপাশজুড়ে রয়েছে পুঠিয়া মন্দির গুলো । এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে পঞ্চরত্ন শিব, মন্দির, চৌচালা গোবিন্দ মন্দির, গোবিন্দ মন্দির, মন্দির বাজার, জগদ্ধাত্রী মন্দির । পুঠিয়া জমিদাররা অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে এই মন্দির নির্মাণ করেছিলেন । বিশালাকারের জায়গা জুড়ে এত মন্দির বাংলাদেশের আর কোথাও দেখা যায় না । একমাত্র ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরে এ ধরনের মন্দিরের সমাহার রয়েছে ।
৭) আদিনাথ মন্দির, মহেশখালীঃ- বাংলাদেশের হিন্দু মন্দির
চতুর্থ তালিকায় থাকা বাংলাদেশের কক্সবাজারে অবস্থিত আদিনাথ মন্দির বাংলাদেশের একটি বিখ্যাত হিন্দু মন্দির । এটি বাংলাদেশের উপকূলীয় শহর কক্সবাজার থেকে ১২ কিলোমিটার দূরের দ্বীপ মহেশখালীতে অবস্থিত । হিন্দু সম্প্রদায়ের দেবতা দেবাদিদেব মহাদেবের নাম অনুসারে এই মন্দির প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় এই মন্দির শিব মন্দির নামে বহুল প্রচলিত । হিন্দু ধর্মের মানুষ এই মন্দিরের বিগ্রহ দেবতা মহাদেবকে খুব জাগ্রত দেবতা হিসাবে ভক্তি করেন ।
৮) চন্দ্রনাথ মন্দির, সীতাকুন্ডঃ- বাংলাদেশের হিন্দু মন্দির
তৃতীয় স্থানে চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড-তে চন্দ্রনাথ পাহাড়ের উপরে অবস্থিত চন্দ্রনাথ মন্দির অপর একটি হিন্দুদের বিখ্যাত তীর্থস্থান । এটি সতীর ৫১ পীঠের মধ্যে অন্যতম । হিন্দু পুরাণ অনুসারে এখানে সতীর দক্ষিণ হস্ত পতিত হয়েছিল । চন্দ্রনাথ পাহাড়ের সর্বোচ্চ চুড়ায় অবস্থিত চন্দ্রনাথ মন্দির সীতাকুণ্ড মন্দির নামেও পরিচিত । সীতাকুণ্ড মন্দির ছাড়াও এখানে পাশাপাশি আরো বেশ কয়েকটি মন্দির রয়েছে । শিবরাত্রির শিব চতুর্দশী তিথিতে বিশেষ পূজা হয় এখানে । এই পূজাকে কেন্দ্র করে সীতাকুণ্ডে বিশাল মেলা হয়, যেটি শিবচতুর্দশী মেলার নামে পরিচিত । এই মেলায় বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে অসংখ্য সাধু এবং নারী পুরুষ যোগদান করেন।
৯) কান্তজির মন্দির বা কান্তনগর মন্দির, দিনাজপুরঃ- বাংলাদেশের হিন্দু মন্দির
দ্বিতীয় স্থানে কান্তজির মন্দির বা কান্তনগর মন্দির বাংলাদেশের দিনাজপুর এ অবস্থিত একটি সু প্রাচীন মন্দির । তিন তলা বিশিষ্ট এই মন্দিরে খুব সুন্দর ধর্মীয় স্থাপনার নিদর্শন দেখা যায় ।
১০) ঢাকেশ্বরী মন্দির, ঢাকাঃ- বাংলাদেশের হিন্দু মন্দির
প্রথম তালিকায় থাকা বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাতে অবস্থিত ঢাকেশ্বরী মন্দির বাংলাদেশের জাতীয় মন্দির । ঢাকা শহরের রক্ষাকর্ত্রী দেবী হিসাবে এই মন্দিরের নামকরণ করা হয়েছিল ঢাকেশ্বরী মন্দির । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সলিমুল্লাহ হলের দক্ষিণ পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত উজ্জ্বল হলুদ এবং লাল বর্ণের এই মন্দির । এই মন্দিরের উত্তর-পশ্চিম কোণে রয়েছে চারটি শিব মন্দির । এখানে দেবী দুর্গার একটি ধাতু নির্মিত প্রতিমা রয়েছে ।