সারা পৃথিবী জুড়ে যে সমস্ত বড় বড় বাসভবন রয়েছে, তার মধ্যে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবন অন্যতম । পৃথিবীর সেরা রাষ্ট্রপতি ভবন হিসেবে ভারতের প্রেসিডেন্ট হাউস এর নাম প্রথমদিকে ।
রহস্যময়, সৌন্দর্যময় ও বিলাসবহুল এই আবাসন হল বিশ্বের বৃহত্তম প্রেসিডেন্ট হাউস । ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবন সম্পর্কে জানতে হলে এমন কিছু আশ্চর্য কথা জানা যায় যা আমাদের মনকে ভাবিয়ে তুলবে । ৩৩০ একর জায়গার ওপর তৈরি চারতলা বিশিষ্ট এই বাসভবনে রয়েছে ৩৪০ টি শোয়ার ঘর । ২.৫ কিলোমিটার বিশিষ্ট করিডোর রয়েছে । আছে বিশাল আয়তনের লাইব্রেরী । যেখানে রয়েছে ইন্ডিয়ান ও ব্রিটিশ পাবলিকেশন এর হরেক রকমের বই । এই সমস্ত বই শুধু মাত্র পাঁচ বছর কেন পনের বছরেও পড়ে শেষ করা সম্ভব নয় । এছাড়া আছে ১৯০ একর জায়গা জুড়ে রয়েছে মোগল গার্ডেন, গোলাপের বাগান, কমলা লেবু, নানা প্রজাতির হাজার হাজার গাছ । এর পাশাপাশি রয়েছে জলাধার, ফোয়ারা, ময়ূর পয়েন্ট, প্রজাপতি পয়েন্ট ইত্যাদি । ভিতরে আছে মোগল দরবার হল । অসামান্য কারুকর্যময় এই বাসভবনের শোভা এক অন্য মাত্রায় নিয়ে যায় । এখানে আছে দামি উপহার সামগ্রী রাখার জন্য মিউজিয়াম । রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে যেসব উপহার পেয়ে থাকেন সেগুলো সুরক্ষিত রাখতে একটি মিউজিয়াম রয়েছে । মুলত এটি একটি ছোটখাটো শহর, যেখানে ব্যাংক, পোস্ট অফিস, টেলিফোন বুথ থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় সব কিছু জিনিস রয়েছে ।
এখন প্রশ্ন জাগতেই পারে এত রাজকীয়তা ও বিলাসবহুল প্রাসাদে বাস ভবন তৈরি কি নিছকই বিলাসিতা নাকি প্রয়োজনীয়তা ? ইতিহাস বলছে এই গল্প শুরু হয় পরাধীন ভারতের ব্রিটিশ সম্রাট পঞ্চম জর্জের সময়ে । সেই সময়ে ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লী স্থানান্তরিত করার কথা হয় । ভারতবর্ষের মধ্যবর্তী জায়গায় দিল্লি শহর থাকার জন্য ইংরেজরা ভারতের নতুন রাজধানী হিসেবে দিল্লীকেই বেছে নেয় । রাজা পঞ্চম জর্জ দিল্লিকে রাজধানী শহরের আদলে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন । ১৯১২ সালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সবচেয়ে উচ্চ পদস্থ ব্যক্তির জন্য একটি এমন প্রাসাদ তৈরী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যে একবার দেখবে, সে যেন মৃত্যুর আগে পর্যন্ত এই প্রাসাদের কথা না ভোলে । এই গুরুভার দেওয়া হয় সেসময়কার বিখ্যাত ব্রিটিশ স্থপতি এডউইন লুটিয়েন্সকে । এডউইন লুটিয়েন্স ইংল্যান্ড থেকে ভারতে এসে সেখানকার বিভিন্ন জায়গা ঘুরে পাথর পর্যবেক্ষণ করেন । অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তারপর তিনি বেছে বেছে পাথর বাছাই করেছিলেন । পাঁচ হাজার লোক এই কাজে নিযুক্ত ছিল । যার মধ্যে তিন হাজার লোক পাথর কাটার কাজে নিযুক্ত ছিল । ২৯০০০ শ্রমিক সতেরো বছর ধরে তখনকার ভাইসরয়ের জন্য এই বাসভবন তৈরি করেন । তখন এই বাসভবনের নাম ছিল ভাইসরয় হাউজ । ১৯২৯ সালে লর্ড ইভিন এই ভবনে ওঠেন ।
১৯৪৭ সালের ১৫ ই আগস্ট ভারত স্বাধীন হওয়ার পর এই ভবনের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় গভর্মেন্ট হাউস ।মোগল ও পাশ্চাত্য স্থাপত্য শিল্পে তৈরি এই ভবন এখন ভারতবাসীর অহংকার হলেও এই ভবনে লুকিয়ে আছে ভারতীয়দের বঞ্ছনার ইতিহাস । প্রেসিডেন্ট হাউস এর ব্যাংকুয়েট হল এর দেওয়ালের লাল চিহ্ন সবসময় মনে করায় সেই কথা । এই ভবনটি ভারতের মাটিতে ও ভারতীয়দের রক্ত জল করা পরিশ্রমে তৈরি হলেও উপরে যাওয়ার অনুমতি ভারতীয়দের ছিল না । সেখানে শুধু সাদা চামড়ার ব্রিটিশদের যাওয়ার অধিকার ছিল ।
ভারতের প্রথম গভর্নর জেনারেল রাজাগোপালাচারী প্রথম বাস ভবনে ছিলেন । তিনি প্রথমে এই ভবনের গেস্ট হাউসে গিয়ে থাকেন । যে ঘরে ভাইসরয় থাকতেন সে ঘর ব্যবহার করা হয় না । সেই ঘরটি এতটাই বড় যে বলে বোঝানো সম্ভব নয় । ১৯৫০ সালে রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ এর সময় এই ভবনের পাকাপাকি নামকরণ হয় রাষ্ট্রপতি ভবন । রাজেন্দ্র প্রসাদ রাজাগোপালাচারীর পথ অনুসরণ করে এই ভবনের গেস্ট হাউসে গিয়ে থাকেন । আর তখন থেকেই এই নিয়ম অনুসরণ করে চলেছে ভারতের সকল রাষ্ট্রপতি ।
রাষ্ট্রপতি ভবনের ২৩ মিটার উঁচু ইংল্যান্ডের তৈরি ক্লক টাওয়ার নজর কাড়ার মতো ।রুপার সিংহাসন, কাঠের মেঝের ওপর কাশ্মিরী কার্পেট , দেওয়ালে চিত্র শিল্প, অপূর্ব ভাস্কর্য ও মূর্তির অলংকৃত সমাহার এই রাষ্ট্রপতি ভবন এখন আর ব্রিটিশদের নয় , সমগ্র ভারতবাসীর অহংকারের প্রতীক ।
মাননীয় প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় এর হাত ধরে অনলাইনের মাধ্যমে আবেদন করে এই ভবনের ভেতরে প্রবেশ সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে হয়েছে । এখন যার পোশাকি নাম ইন রেসিডেন্স । এছাড়া পরিচয় পত্র সঙ্গে নিয়ে প্রতি শনিবার সকালে চেঞ্জ অফ গার্ডের অনুষ্ঠানে সাধারণদের প্রবেশের অনুমতি রয়েছে । এই রাষ্ট্রপতি ভবনের বর্তমান মূল্য ১২ বিলিয়ন ইউএস ডলার ।