(১)

রবিবার সকালটা বেশ ভালোই চলছিল। বারান্দার চেয়ারখানি’তে বসে উমা’কে বললাম, “কই গো, এক কাপ চা দিয়ে যাও তো। আর সঙ্গে আমার মোবাইল’টাও দিও।” নেশার মধ্যে এই চা জিনিসটা আমি আর কোনদিন ছাড়তে পারবোনা। কলেজ লাইফ থেকেই আমার এই চা এর নেশা; একটানা ৩-৪ ঘণ্টা বই এর মধ্যে থাকার পর এক কাপ চা না পেলে কেমন যেনো অস্বস্তি হতো, মনে হতো যে আমার জীবনের কোনও একটা খুব প্রয়োজনীয় বস্তু তালিকা থেকে বাদ পড়ে গেছে। তবে এখন নিয়মিত ৮:৩২ এর ট্রেন ধরার ব্যস্ততায় একদিনও শান্তি করে বসে চা পান করা হয়না সকালে। বলে রাখা ভালো, আমি একজন সাধারণ বেসরকারি কর্মচারী। আর তার ফল টা ঠিক সময় মতো আপনারা দেখতে পাবেন।

সরকারি চাকরি’র চেষ্টা করেছিলাম বটে, তবে তাতে তেমন কোনও ফল হয়নি। একেই ব্রাহ্মণ, তার ওপর আমাদের পরিবারে সরকারি চাকরি এখনও পর্যন্ত নাকি কেউ পায়নি, জেঠু বলতো “বৃথা চেষ্টা, আমাদের রক্তে ও নেই!” আর সেকারণেই একপ্রকার জেদ চেপে গিয়েছিল মনে। বাবা বলতো যে, “ছেলে আমার ডব্লিউ বি সি এস অফিসার হবে।” তবে কেউ যদি কখনও পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে বসতো যে, “আর যদি তা না হয়?” কিছুক্ষণ চুপ থেকে হাল্কা হাসতো বাবা। সেই হাসিটার মানে এখন আমি বুঝি। সমাজে প্রতিদিন যারা নিজের পরিবারকে বাঁচাতে ক্রমাগত অর্থের সাথে লড়াই করে চলেন, দু’পয়সা বেশী রোজগারের জন্য টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে দিনের পর দিন একবেলা শুধু জল খেয়ে কাটিয়ে দেন, তাঁরা অমন হাসি হাসতে জানেন।

আরে সেই কখন চা চেয়েছি, এখনও উমার কোনও খোঁজ নেই যে! এমনকি এর মধ্যে আমার ডায়েরির এক পাতা লেখা হয়ে গেলো। আরেকবার আওয়াজ দিলাম, “আরে ও উমা, গেলে কই? বলছি দশ’টা তো বাজে।”

এবার চা এলো। শুধু এলো বললে ভুল হবে, একেবারে সাইক্লোন এর রূপ নিয়ে এলো। প্রচণ্ড দ্রুতপদে চা টা দিয়ে দৌড়ে ফেরত গেলো উমা। আমি বলে উঠলাম, “আর ফোনটা?” দৌড়াতে দৌড়াতে সে বলে গেলো, “ওটুকু তো নিজেই নিতে পারো নাকি?”

তা বটে। বেচারি একা আর কত কষ্ট করবে? আমার না হয় আজ রবিবার, তাঁর তো আর সেই ফুসরত নেই। মধ্যবিত্ত মানুষ আমরা; মধ্যবিত্ত বলাও ভুল, মাসে ৭,০০০ টাকা বেতন পাওয়া কর্মচারীকে এখন আর মধ্যবিত্ত বলা চলেনা। আর একারণেই ঘরের বাসন মাজা থেকে শুরু করে ঘর মোছা, রান্না করা, জামাকাপড় কাচা সব উমা’র একার দায়িত্ব, তার ওপর ঝামেলা বাড়াতে পুচকি তো আছেই। মা’কেও দেখতাম ঠিক এরকম। আচ্ছা মেয়েদের মধ্যে কি বিধাতা বিশেষ কোনও যন্ত্র লাগিয়ে পাঠায়? যদি তাই হয়, সত্যিই ভারি আশ্চর্য সে যন্ত্র। মানসিক সমস্যা থেকে আর্থিক, পারিবারিক সমস্ত রকমের ঝড়কেই অনায়াসে সহ্য করার ক্ষমতা রাখে সে যন্ত্র, তার ওপর খারাপ হওয়ার কোনও ভয় নেই। তবে উমা’র টা কিন্তু খারাপ হয়েছিলো!

বংশ পরম্পরায় প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী পরিবার উমা’দের। শহরে অনেক নাম-ডাক’ও আছে। এই তো সপ্তাহখানেক আগে শিয়ালদহ থেকে ফিরছি, ট্রেনে এক অপরিচিত ভদ্রলোক আচমকা ডেকে বললেন, “তুমি রমেনের জামাই না?” আমি সবে মাত্র ভদ্রতা দেখাতে যাবো, তার আগেই ভদ্রলোক ছুড়ি’টা বসিয়ে দিলেন। বললেন, “তা বাবা, এখন কি ভালো কোনও কাজ পেয়েছো?” আমি অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম। ভদ্রলোক নিজেই আবার বললেন, “শুনেছিলাম রমেন তোমাকে ওর ব্যবসায় হিসেব-নিকেশ এর দায়িত্ব দিতে চেয়েছিলো। কাজ’টা না করে তুমি কিন্তু বড়ো ভুল করেছ বাবা। সেদিন যদি রমেনের কথায় হ্যাঁ বলতে, এখন এভাবে রোজ রোজ বনগাঁ-শিয়ালদহ ছোটাছুটি করতে হতোনা। আর তাছাড়া সম্পর্কটাও ভালো থাকতো।”

আমি যে অস্বস্তি বোধ করছি, তা বোঝার ক্ষমতা ভদ্রলোকের একেবারেই ছিলনা মনে হয়। আড়চোখে চেয়ে বুঝলাম, কামরার বেশ কিছু লোক আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে, মনে হয় আমার মতো একটা নিষ্কর্মা বোধহীন লোককে দেখে অবাক হয়েছে তারা। তাছাড়া ভদ্রলোকের গলার স্বর খুবই উঁচু, তাই আমার সাংসারিক জীবনের গল্প সেদিন সারা কামরার লোকে শুনেছে। ভদ্রলোক কিন্তু থামেননি, বলে চললেন “বেচারি উমা! বাবা, দাদা দের একমাত্র আদরের মেয়ে ছিলো। এখন নাকি সে বাপের বাড়িতেই আসতে পারেনা!”  এবার আর সহ্য করতে পারলামনা আমি। বললাম, “কাকাবাবু আবার পড়ে কোনদিন কথা হবে। এখন আমাকে নামতে হবে।”

তিনি বললেন, “সে কি, বীরাটি নামবে কেন?”

,“কিছু জরুরি কাজ আছে, চললাম। নমস্কার।”

সত্যিই অনেক বড়লোক ঘরের মেয়ে উমা। তবে আমার সাথে ওর প্রেমের সম্পর্কটা জানতে পেরেও কোনদিন বাঁধা দেয়নি ওর বাড়ির লোক। ভেবেছিল যে পড়াশোনায় ভালো যখন, ঠিক কিছু একটা ভালো চাকরি পেয়েই যাবো; কিন্তু আমি যে এতো বড় অকর্মণ্য প্রমাণিত হব, তা কে জানতো? এমনকি বিয়ের আগে উমা’ও এই নিয়ে বেশ খানিক কথা শুনিয়েছে আমায়। অবশেষে যখন বুঝল যে কোনতাতেই কিছু প্রভাব পড়েনা আমার ওপর, বাধ্য হয়েই পরিবারের বিপরীতে যেতে হয়েছিলো তাঁকে। পরে অবশ্য মেনে নিয়েছিল উমা’র পরিবার, কিন্তু তার বদলে এমন এমন শর্ত দিয়েছিল যা আমার মতো উচ্চ আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়।


(২)

তারপর থেকে কোনদিন আর একটাও কথা শোনায়নি আমাকে উমা। সংসারের অনেকরকম দুশ্চিন্তা এসেছে, অনেক ঝড় এর মুখোমুখি হতে হয়েছে দু’জনকে, তবু এর জন্য একবারও দোষারোপ করেনি সে আমাকে। হয়তো সেও আমার মতো ভাগ্যের দোহাই দিয়ে মেনে নিয়েছে এগুলো। শুধু যখন দু’জন শান্তভাবে কোনও কোনও দিন ছাঁদের ওপর বসে গল্প করি, উমা আমাকে বলে, “তুমি না কেমন একটা।”

,“কেমন বলতো?”

,“সেটাই তো বুঝতে পারিনা।”

,“তা সেই কেমন’টা ভালো না খারাপ?”

উমা বলে, “খারাপ নয়, বেশ অন্যরকম। ওই যে, কেমন একটা…”

আমি আর প্রশ্ন করিনা, শুধু হাল্কা হাসি মনে মনে। সে যে এতগুলো বছর সব চুপচাপ সহ্য করে আমার পাশে দাঁড়িয়েছে, এই আমার অনেক পাওয়া। তা সে একটু-আধটু “কেমন একটা..” লাগলেও আফসোস নেই।

টাকা-পয়সা নিয়ে প্রতিনিয়ত দুশ্চিন্তায় পড়তে হতো ঠিকই, তবে খারাপ চলছিলনা দিনগুলো। ছোট্ট পুচকি’ও যেনো আমাদের বন্ধু হয়ে উঠছিলো দিন দিন। কিন্তু ওই যে প্রবাদ আছে, “যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যা হয়!”

গরীবের সংসার সামলাতে সামলাতে দিন দিন যেনো হাঁপিয়ে উঠছিলো উমা। যে মানুষ একা হাতে সারাদিন বাড়িময় ছোটাছুটি করে সমস্ত সময় কাজ করে বেড়াতো, তাকে আসতে আসতে অমনোযোগী হয়ে উঠতে দেখলাম। কখনও কিছু চাই তো যেনো খেয়ালই থাকেনা উমা’র, কিংবা হয়তো শুনতে পেয়েও সাড়া দেয়না কখনও কখনও। আমি চুপচাপই থাকি বেশীরভাগ সময়, তবে উমা আর পুচকি মিলে সাড়া বাড়িটা’কে মাছের বাজার বানিয়ে তুলতো রোজ। কিন্তু সে বাজারও আসতে আসতে শান্ত হয়ে পড়তে দেখলাম।

আমাদের সুখের সংসারে হয়তো সত্যিই এবার অভাবের ছায়া স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। কিন্তু কী করবো? আমিও যে নিরুপায়, আর এই ৩৯ বছর বয়সে নতুন করে চাকরি খোঁজার ইচ্ছাটাকে জাগানো যে কি কঠিন, তা আমি কিকরে বোঝায় উমা’কে? উমা’কে দেখে ইদানিং কেমন কেমন যেনো ভয় ভয়ও লাগে আমার। সব সময় মুখটা গম্ভীর করে নিজের মতো কাজ করে চলেছে সে, আমি পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেও যেনো চিনতে পারেনা। এমনকি এমনও হতে লাগলো যে, সপ্তাহের ৬ দিনের মধ্যে ৪ দিন অফিসে টিফিন নিয়ে যায়না আমি; তবে সেদিকেও যেনো খেয়াল নেই উমা’র।

এভাবে মাসখানেক চলল। তারপর হঠাৎ ভারি জ্বর হল উমা’র। প্রথমে সেটাকে স্বাভাবিক জ্বরই ভেবেছিলাম, আর সেকারণে উমা নিজেও ডাক্তারের কাছে যেতে চাইলনা। কিন্তু এক সপ্তাহ ফার্মেসি থেকে ওষুধ এনে খাওয়ার পরও যখন অবস্থার কোনও পরিবর্তন হলনা, আসতে আসতে চিন্তা বেড়ে গেলো আমার। ডাক্তার দেখাতে হবে উমাকে। তবে সমস্যাটা হল, নিজে উঠে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার ক্ষমতা নেই উমার। টানা এক সপ্তাহ জ্বরের কবলে থাকার ফলে সে এতটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে যে, বিছানা ছেড়ে ওঠার মতো শক্তি আর পাচ্ছেনা উমা। সুতরাং বাড়িতেই ডাক্তার ডেকে আনতে হবে, আর সেখানে খরচের হিসাবটাও যেনো আপনা হতেই আমার মাথার মধ্যে চলে এলো।

রীতিমতো ডাক্তার এলো। ডাক্তার অবশ্য ভয়ের তেমন কিছু দেখলেননা। জ্বর, ঠাণ্ডা লাগা, গা-হাত-পা ব্যাথা ব্যাথা করা, এসব শুনে ডাক্তার আমাকে জানালেন যে, উমা’র ফ্লু হয়েছে। কয়েক সপ্তাহ জ্বর থাকতে পারে বটে, কিন্তু ওনার লেখা ওষুধ’গুলো খেলে যে উমা পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠবে, একথাও নিশ্চিত করলেন ডাক্তার।

পুচকি’র বয়স সবে ৯, তবে এর মধ্যেই যেনো অনেকটা গিন্নী হয়ে উঠেছে সে। আমি সকালে অফিসে যাওয়ার আগে রান্না করে যায় রোজ, আর বাড়ি ফিরে বাসন মাজা, ঘর মোছা এসব কাজগুলো করি। সারাদিন উমা’কে ঠিকমতো খাবার দেওয়া, ওষুধ খাওয়ানো, এসব পুচকি একাই করে এখন। বেশ কয়েকবার ভেবেছি বটে, উমা’র সেবার জন্য কাউকে একটা ডাকলে খুব ভালো হতো এই সময়। তবে তার পরই মনে পড়ে যায়, ১ বছর আগে পুচকির ডেঙ্গু হওয়ার পর বড়দি এসে কি কথা’টাই না শুনিয়েছিল উমা’কে। সেদিন রাতে আমাকে জড়িয়ে খুব কেঁদেছিল উমা; একজন মা’কে যদি কখনও এটা শুনতে হয় যে তার অযত্নের কারণেই মারা যেতে বসেছে তার ছোট্ট মেয়ে, এর চেয়ে কষ্টের হয়তো আর কিছু হতে পারেনা সংসারে।


(৩)

দিন দিন আরও খারাপ হতে লাগলো উমা’র অবস্থা। ডাক্তারের ওষুধ কিছুমাত্র কাজে দিয়েছে কিনা আমার সন্দেহ! প্রায় দেড় মাস হয়ে গেলো উমার জ্বর, বিছানা ছেড়ে উঠতে পারছেনা সে একদমই। উপায় না পেয়ে আমি অফিস থেকে ছুটি নিয়েছি একমাস; এই একমাসের বেতন যে আমি এক পয়সাও পাবোনা তা জানি, কিন্তু আগে তো উমা।

শুধু জ্বরই নয়, জ্বরের সাথে সাথে আরও বেশ কিছু লক্ষণ প্রকাশ পেতে লাগলো এবার উমা’র মধ্যে। কেমন একটা লাল লাল র‍্যাশে ভর্তি‌ হয়ে যেতে থাকে উমা’র মুখ ও গলা। এমনকি বিগত বেশ কিছুদিন যাবৎ লক্ষ করছি যে স্নান করার সময় প্রতিদিন উমা’র মাথা থেকে বেশ খানিকটা করে চুল আমার হাতে উঠে আসে। শরীর’টাও যেনো অনেকটা রোগা হয়ে গেছে তাঁর। আর হওয়াটাই স্বাভাবিক, একদিনও তো ঠিকমতো খেতে চায়না। সেই সঙ্গে আসতে আসতে আমারও খাওয়া বন্ধ হয়ে যেতে থাকে। পুচকি’কে খাইয়ে দিই রোজ ঠিক মতো, কিন্তু নিজের মধ্যে জোড় করেও সেই ইচ্ছাটা যেনো জাগাতে পারিনা। উমা কিন্তু এসব কিছুই জানেনা; প্রায় এক মাস হলো, আমি বা পুচকি কারও সাথেই কথা বলেনা সে। সবসময় কেমন যেনো অনুভূতিহীন পাথরের মতো পড়ে আছে বিছানায়। বড়ো কোনও রোগ হয়েছে উমা’র, আমি নিশ্চিত; কিন্তু ডাক্তার দেখাবো কীভাবে আমি? বারবার মনে হয় উমা’কে ডেকে বলি, “ও উমা, চলনা একটু ছাঁদে গিয়ে বসি। আমাকে কেমন লাগে বলবেনা?”


(৪)

প্রায় ৩ মাস হয়ে গেছে আমি বাড়িতে থেকে উমা’র দেখভাল করছি। অফিসের ছুটিটা পুরোপুরি পার্মানেন্ট হয়ে গেছে এবার। দু’মাসের ঘরভাড়া এখনও বাকি। এর আগে কোনদিন মাসের ১ তারিখ ছাড়া ২ তারিখে ভাড়া দিয়নি, তাই হয়তো এখনও তলব করেননি সুভাষ দা। পুচকি’টারও কপাল খারাপ, এতটুকু বয়সে কতই না অভিজ্ঞ হতে হচ্ছে তাঁকে।

এতদিন বাদে আমার সাথে কথা বলল উমা। সেদিন যখন উমা’কে স্নান করিয়ে বিছানায় শুয়িয়ে দিয়ে নিজে স্নান করতে যাবো ভাবছি, হঠাৎ আমার হাতটা চেপে ধরে উমা বলল, “শোনো..”। মুহূর্তের মধ্যে আমার সাড়া শরীরে শিহরণ খেলে গেলো; কথা বলেছে, উমা কথা বলেছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে জানতে চাইলাম, “কী হয়েছে উমা? কী চাই, বলো আমায়।”

উমা বলল, “একবার বাবার কাছে যেতে পারবে? একটিবার ওদেরকে দেখতে ইচ্ছা করছে খুব।”

রইল পড়ে আমার আত্মসম্মান, স্নান না করে সেদিনই আমি ছুটলাম শ্বশুরবাড়ির দিকে। প্রায় আড়াই ঘণ্টা লাগে আমার বাড়ি থেকে সেখানে যেতে। পুচকি’কে উমা’র দায়িত্ব দিয়ে আমি বেরিয়েছি। সকাল থেকে স্নান, খাওয়া কিচ্ছু হয়নি; সেকারণে ভারি অদ্ভুত দেখাচ্ছিল আমাকে, একথা আমি নিজেও বুঝতে পারছিলাম। ব্যাপারটি আমার শ্বশুরমশাই এরও যে নজরে পড়েছে, তা তাঁর মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল।

উমা’র বাবা-মা’কে সবটা বলতে তাঁরা যেনো আকাশ থেকে পড়লেন। উমা’র দাদা দ্রুতপায়ে এসে আমার জামার কলারটা চেপে ধরল, হয়তো তাঁদের বাড়ির মেয়ের এমন অসুস্থতার জন্য আমাকেই দায়ী করছেন তাঁরা। সেই প্রথম কারও অপমানে আমার চোখে জল এসেছিলো; শুধু অপরাধ বললে ভুল হবে, ফাঁসির আসামীর সাথেও তুলনা করেছিল তাঁরা আমায়। কিন্তু উমা যে আমার কাছে কতটা, তা অন্য কাউকে আমি কিকরে বোঝাবো?

বিয়ের পর এই দ্বিতীয় বার বাপের বাড়ি গেলো উমা। প্রথমবার যখন গেছিলো, আমার জন্য অনেক অপমান সহ্য করতে হয়েছিলো তাঁকে। তবে এবার আর অপমান নয়, বাবা, মা, দাদা সকলেই অনেক আদরের সাথে ফিরিয়ে নিয়ে গেলো তাঁদের বাড়ির মেয়েকে। পুচকিও গেলো উমার সাথে; নাতনি বলে কথা, অনেকটা দেরিতে হলেও শেষ পর্যন্ত দাদু-দিদা’র যত্ন পাবে মেয়েটা আমার।

যাওয়ার দিন পুচকি আমার ঘরে এসে বলল, “বাবা তুমি এখনও রেডি হওনি? সবাই গাড়িতে উঠে পড়বে এক্ষুনি।” আমি তখন আমার আর উমার ফটো অ্যালবাম’গুলো গোছাচ্ছিলাম। পুচকির মাথায় একটা চুম্বন করে বললাম, “তোমরা যাও মা, আমি পড়ে যাবোখন।”


(৫)

উমা চলে গেলো, আমি পুরোপুরি একা। ২ মাস হয়ে গেছে, জানিনা উমা কেমন আছে। স্নান নেই, খাওয়া নেই, সারাক্ষণ কিসের একটা নেশায় উমার বিছানার পাশের চেয়ার’টায় বসে আছি। উমা’র একবারও দেখতে ইচ্ছা হয়নি আর আমাকে? পুচকিও কি ভুলে গেছে আমায়? ওরা কি তবে বুঝতে পেরেছে যে আমার মতো অকর্মণ্যের সাথে থেকে ওদের জীবন নষ্ট হয়েছে এতদিন? সত্যি, পৃথিবীতে টাকা’য় সব। যার টাকা থাকে, সে সব কিছু পারে, সবার প্রিয় সে। আজ যদি আমারও অতো টাকা থাকতো, পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতাম উমা’কে।

এর ঠিক ১ সপ্তাহ পড়ে কে একটা এসে হঠাৎ একদিন ডাকাডাকি করতে লাগলো। বাড়ির বাইরে এখন আর তেমন বেরোয়না আমি, অনেকদিন হল ফোনে রিচার্জ‌’টাও করা হয়নি। বাইরে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম কী হয়েছে।

ভদ্রলোক বলল, “একবার ও বাড়ি চলুন, রমেন বাবুর স্ত্রী ডেকে পাঠিয়েছেন।” এতদিন অধীর আগ্রহে এই ডাক’টার জন্যে অপেক্ষা করেও কেনো জানিনা সেই পরিমাণ আনন্দ পেলামনা।

উমা আর নেই! উমা’দের বাড়িতে গিয়েই প্রথম খবরটা পেলাম আমি। অনেক বড়ো একজন ডাক্তারকে দেখিয়েছিলো উমা’র বাড়ির লোক, অনেক চেষ্টা করেও শেষ রক্ষা হয়নি। ‘লুপাস’ রোগ হয়েছিলো উমা’র। ১ কোটি’তে একজনের হয় ওই রোগ।

আমার চোখ ভেজেনি। উবু হয়ে বসে উমা’র মুখ টা দেখছি, পুরো মুখটা ক্ষতচিহ্নে ভরে গেছে। পাশাপাশি একবার তাঁর পুরানো ঝলমলে মুখটা ভেসে উঠলো চোখের সামনে, অস্ফুটস্বরে একবার ডাকলাম “উমা!”


(৬)

“আরে এ পাগল, কিসব লেখালেখি করছিস এতো মন দিয়ে?” বলেই ফুটপাতের একটা পাগলের কাছ থেকে তাঁর হাতের ডায়েরিটা কেড়ে নিলো ভদ্রলোক। তারপর বলল, “ওই যে খাবার রেখে দিয়েছি, খেয়ে নিস।”

পাগলটা সামনে পড়ে থাকা বিস্কুটের প্যাকেট’টা হাতে তুলে নিলো।

ভদ্রলোক রাস্তার ধারে বসে ডায়েরি’টা দেখতে লাগলো। ডায়েরি’র কভারে বড়ো বড়ো করে লেখা “উমা”

Atanu Chakraborty is a content and news writer at BongDunia. He has completed his Bachelor Degree on Mass Communication from Rabindra Bharati University. He has worked with mainstream media, in the capacity of a reporter and copywriter.

Leave A Reply