বং দুনিয়া ওয়েব ডেস্কঃ অত্যন্ত ছোটবেলা থেকেই নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু নিজেকে আলাদা প্রমান করেছেন, তা সে পড়াশুনায় হোক, কিম্বা স্বভাবে বা চিন্তাভাবনায় । ছাত্র জীবনে নেতাজীকে সরাসরি রাজনৈতিক ক্রিয়াকর্মে খুব বেশী যোগ দিতে দেখা যায়নি । তবে ইংল্যান্ডে তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজউইলিয়াম হলে উচ্চশিক্ষার্থে ভর্তি হন। ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি এই কলেজের পরীক্ষায় চতুর্থ স্থান লাভ করেন এবং মরাল সায়েন্স কেম্ব্রিজ ট্রাইপস অধিকার করেন। ইতিমধ্যে ভারতে নানা রকমের ঘটনা ঘটে যায়।
জানা যায়, ১৯১৯ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর, কয়েক সপ্তাহ আগে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা শেষ হয়েছে। তখনই ভারত ছেড়ে সুভাষ পাড়ি জমালেন ইংল্যান্ডে। এপ্রিলের ১৩ তারিখ ভারতে ঘটে যায় ইতিহাসের অন্যতম নৃশংস এক হত্যাকাণ্ড, ব্রিটিশ সেনারা পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগে চালায় সে হত্যাকাণ্ড। ক্ষোভে ফুঁসে উঠে সারা ভারত। রবীন্দ্রনাথ তার ‘নাইট’ উপাধি বর্জন করেন। ভারতীয় সাধারণ জনগণের মতো তার মনেও চাপা ক্ষোভ দানা বাঁধে। কিন্তু তখন তার বিলেত যাওয়া ঠিকঠাক। তাই বিলেতে পড়ালেখার পাশাপাশি তিনি জাতীয় আর আন্তর্জাতিক রাজনীতির খুঁটিনাটি, দর্শন, ইতিহাস আর অর্থনীতির জ্ঞানকেও ঝালাই করে নিলেন। বিলেতে পা রেখেই বুঝতে পারলেন ভারতে ব্রিটিশ শাসনের হালচাল সম্পর্কে খুব কমই জানে সাধারণ ব্রিটিশরা।
সংবাদপত্রে ভারতের ব্যাপারে খুবই কম সংবাদ পাওয়া যেত, তাই দেশের অবস্থা নিয়ে যা জানবার তার শতভাগই আসতো আত্মীয়স্বজন কিংবা পরিচিতদের সাথে বিনিময়কৃত চিঠি থেকে। ১৯২১ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি তিনি চিত্তরঞ্জন দাশকে লেখা চিঠিতে জানালেন তিনি আইসিএস অর্থাৎ ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে চতুর্থ হয়েছেন, কিন্তু তিনি চাকরিতে যোগ দিচ্ছেন না। দেশে ফিরে মানুষের জন্যই কাজ করতে চান। সেই চিঠিতেই কংগ্রেসের সাথে যোগ দেওয়ার চিন্তা চিত্তরঞ্জন দাশকে জানালেন তরুণ সুভাষ। ফলে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা প্রত্যাখ্যান করে তিনি ভারতে ফিরে আসার উদ্যোগ নেন। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, “কোনো সরকারের সমাপ্তি ঘোষণা করার সর্বশ্রেষ্ঠ পন্থা হল তা থেকে [নিজেকে] প্রত্যাহার করে নেওয়া”। এর পর থেকেই নেতাজী ধীরে ধীরে রাজনৈতিক মঞ্চে প্রবেশ করেন ।
১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ জুলাই জাহাজ থেকে নেমে গান্ধীজী’র সাথে দেখা করেন। গান্ধীজী’র নির্দেশে তিনি সবার রাজনৈতিক গুরু দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সাথে দেখা করেন। কলকাতায় ফিরে তিনি চিত্তরঞ্জন দাশের অনুপ্রেরণায় স্বরাজ নামক সংবাদপত্রে লেখালিখি শুরু করেন এবং বঙ্গীয় প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির প্রচার দায়িত্বে নিযুক্ত হন। ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে দেশবন্ধু যখন কলকাতা পৌরসংস্থার মেয়র নির্বাচিত হন, তখন সুভাষচন্দ্র তাঁর অধীনে কর্মরত ছিলেন। ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে অন্যান্য জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে তাঁকেও বন্দী করা হয় এবং মান্দালয়ে নির্বাসিত করা হয়।
১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে নেতাজী জেল থেকে ছাড়া পান। এই বৎসরে তিনি বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন। এই সময় বাংলার কংগ্রেস দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। এই দুটি দল সেনগুপ্ত কংগ্রেস এবং সুভাষ কংগ্রেস নামে চিহ্নিত হতো। ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কলকাতা কংগ্রেসকে সামরিক কায়দায় সাজান। এক্ষেত্রে তিনি যে বিশেষ বাহিনী গড়ে তোলেন, তার নাম ছিল ‘বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স‘। সে সময়ে ‘বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স’ বাহিনীতে নারী ও পুরুষ বিপ্লবী ছিল। ‘বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স’ বাহিনীকে সামরিক মানসিকতায় শিক্ষা প্রদান করা হয় এবং এ বাহিনীর প্রতিটি সদস্যকে স্বাধীনতার জন্য যে কোনো ত্যাগ স্বীকারে মানসিক ভাবে প্রস্তুত করা হয়। ‘হিন্দুস্থান সেবক দল’ নামে আরেকটি বাহিনী তৈরি করা হয়েছিল।
১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতায় কংগ্রেস অধিবেশন হয়। এই অধিবেশনে সভাপতি ছিলেন জহরলাল নেহেরু। এই সময় সুভাষ বসুর নেতৃত্বে গড়ে উঠা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী এই অধিবেশনকে বিশেষ তাৎপর্যমণ্ডিত করে তোলে। এই স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক ছিলেন সুভাষবসু। এর সাথে যুক্ত হয়েছিল সে সময়ের বিভিন্ন সশস্ত্র বিপ্লবীদল। এই দলগুলোর ভিতর উল্লেখযোগ্য দলগুলো ছিল― অনুশীলন সমিতি, যুগান্তর, পূর্ণদাস বাউলের দল, উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন বিপ্লবী সংগঠন। কংগ্রেসের এই অধিবেশনের জন্য বিশাল প্রস্তুতি নিয়েছিলেন তিনি।
১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বঙ্গীয় প্রদেশিক কংগ্রেস অধিবশেন সভাপতিত্ব করেন। এই বৎসরের আগষ্ট মাসে ‘নিখিল ভারত লাঞ্ছিত রাজনৈতিক দিবস’ উপলক্ষে তিনি একটি শোভাযাত্রা পরিচালনা করেন। এই কারণে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯২৯ লাহোরে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসে তিনি ও বিপ্লবীরা ব্রিটিশ সরকারের পাশাপাশি একটি সমান্তরাল সরকার গঠন করার প্রস্তাব করেন।
১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ শে জানুয়ারি মাসে দেওয়া রায়ে তাঁর ৯ মাসের জেল হয়। আর ১৮ই এপ্রিল সূর্যসেন মোট ৬৫ জন যোদ্ধা নিয়ে, প্রায় রাত দশটার দিকে আক্রমণ করে চট্টগ্রাম পুলিশ লাইনে অবস্থিত অস্ত্রাগার দখল করেন। এই ঘটনা ব্রিটিশ ভারতের শাসকদের প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছিল। চট্টগ্রামের জালালাবাদ পাহাড়ে বিপ্লবীদের বেশিরভাগ শহীদ হন, কিন্তু অবশিষ্টদের খোঁজার জন্য ব্রিটিশ পুলিশ ব্যাপক ধরপাকড় ও নির্যাতন শুরু করে। এরই ভিতর ২৩ সেপ্টেম্বর সুভাষ জেল থেকে ছাড়া পান। এই বৎসরেই ২৫ সেপ্টেম্বর তিনি কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন।
১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে উত্তরবঙ্গে সাংগঠনিক কাজে গেলে, মালদহের ম্যাজিস্ট্রেট তাঁর জেলায় ঢুকতে বাধা দেয়। এই বাধা অগ্রাহ্য করলে তাঁকে গ্রেফতার করে ৭ দিনের জেল দেওয়া হয়। ২৬ জানুয়ারিতে তিনি কলকাতায় একটি শোভাযাত্রা করলে, পুলিশ শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণকারী জনগণকে বাধা দেয়। এই সময় পুলিশের লাঠচার্জে তিনি মারাত্মকভাবে আহত হন। অজ্ঞান অবস্থায় পুলিশ তাঁকে বন্দী করে হাসপাতালে পাঠায়। বিচারে তাঁর ছয় মাসের জেল হয়েছিল। ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দের ৫ই মার্চ গান্ধী-অরুইন চুক্তি হয়। এই চুক্তি অনুসারে অন্যান্য সকল রাজনৈতিক বন্দীদের সাথে তিনিও মুক্তি পান। উল্লেখ্য ৮ই মার্চ তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল।
১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ শে অক্টোবর ঢাকা জেলার ম্যাজিস্ট্রেট ডুর্নোকে হত্যা করেন তৎকালীন বাংলার দুই বিপ্লবী―সরোজ গুহ এবং রমেন ভৌমিক। এঁদের পুলিশ ধরতে না পেরে, ঢাকার স্থানীয় লোকদের উপর নির্যাতন শুরু করে। এর প্রতিবাদে তিনি ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। ৭ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জ থেকে একটি নোটিশ দ্বারা তাঁকে ঢাকা প্রবেশে বাধা দেওয়া হয়। এই সময় তাঁর সঙ্গীদের ঢাকাতে প্রবেশ করতে দেওয়া হলেও তাঁকে স্টিমারের করে চাঁদপুরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। চাঁদপুর থেকে তিনি আবার ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। ১১ নভেম্বর তাঁকে তেজগাঁও রেল স্টেশনে গ্রেফতার করা হয়। ১৪ নভেম্বর ৫০০ টাকা জামিনে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়। ১৫ই নভেম্বর পুলিশি নির্যাতনে ঢাকার ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলোর সাথে দেখা করেন।
১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দের ১ লা জানুয়ারিতে কংগ্রেসর ওয়ার্কিং কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় ইংরেজের সকল ধরনের রাজনৈতিক অত্যাচারের বন্ধ করার দাবি করা হয় এবং সাতদিনের মধ্যে এই দাবি না মানলে, আইন-অমান্য আন্দোলন-এর হুমকি দেওয়া হয়। এই সূত্রে সরকার গান্ধীজী, জহরলাল নেহেরু, বল্লভ ভাই প্যাটেল-সহ বহু নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে। বোম্বে থেকে ফেরার পথে , বোম্বে রেলস্টেশনের ৩০ মাইল দূরে কল্যাণপুরে সুভাষ বসুকে গ্রেফতার করে প্রথমে মধ্য প্রদেশের সিডনী সাবজেলে পাঠানো হয়। পরে তাঁকে জব্বলপুর সেন্ট্রাল জেলে পাঠানো হয়। জেলে তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতি হলে, তাঁকে ভাওয়াল স্বাস্থ্য নিবাসে পাঠানো হয়। ক্রমে ক্রমে তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতি হলে, তাঁকে চিকিৎসার জন্য ইউরোপ যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়।
১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ ফেব্রুয়ারি তিনি ভিয়েনার উদ্দেশ্যে বোম্বে থেকে জাহাজযোগে রওনা দেন। ৮ই মার্চ তিনি ভিয়েনা পৌঁছান। একটু সুস্থ হয়ে তিনি ইউরোপের সুইজারল্যান্ড, চেকোশ্লোভাকিয়া, রুমানিয়া, বুলগেরিয়া, পোল্যান্ড ইত্যাদি দেশ ভ্রমণ করেন।
১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দে ভিয়েনাতে থাকার সময় তিনি একজন ইংরেজি জানা সেক্রেটারি খুঁজছিলেন। এই সময় তাঁর সাথে অস্ট্রিয়ান বংশোদ্ভুত এমিলি (Emilie Schenkl)-এর সাথে দেখা হয়। এক সাথে কাজ করার সূত্রে, এমিলি’র সাথে তাঁর প্রণয়ের সূত্রপাত হয়। এই বৎসরের ডিসেম্বর মাসে পিতার অসুস্থার সংবাদ শুনে ভারতে ফিরে আসেন। কিন্তু সরকার তাঁকে নির্বাসিত করে ভারত ত্যাগের নির্দেশ দেয়। ফলে তিনি ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দের ৮ জানুয়ারি আবার ইউরোপে ফিরে যান। এই সময় ভারত থেকে প্রথমে তিনি ইতালিতে আসেন। এখানে তাঁর সাথে দেখা হয় মুসেলিনির। ১৬ই জানুয়ারি তাঁর ‘ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল’ নামক বইটি প্রকাশিত হলে, ইউরোপে তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি হয়।
১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দের ১১ এপ্রিল তিনি নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ভারতে ফিরে আসেন। বোম্বের জাহাজ ঘাট থেকে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। এই গ্রেফতারের প্রতিবাদে ১০ মে সুভাষ দিবস পালিত হয়। সুভাষ বসুকে কার্শিয়াং-এর গির্দা পাহাড়ের এক জেলখানায় রাখা হয়েছিল। ডিসেম্বর মাসে তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতি হলে, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করা হয়। ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ মার্চ তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়। ৬ এপ্রিল তাঁকে কলকাতার শ্রদ্ধানন্দ পার্কে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। স্বাস্থ্য পুনোরুদ্ধারের জন্য ডঃ ধর্মবীরের নির্দেশে ১৮ই নভেম্বর তিনি আবার ইউরোপ যান।
১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে বিদেশে থাকাবস্থায় হরিপুরা কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে সভাপতির পদে তিনি প্রতিযোগিতা করেন। ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ই জানুয়ারি কংগ্রেসের জেনারেল সেক্রেটারি আচার্য কৃপালিনী- সুভাষ বসুকে কংগ্রেসের সভাপতি ঘোষণা করেন। মূলত এতকাল কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচনে গান্ধীজী’র ইচ্ছারই প্রতিফলন ঘটতো। এই নির্বাচনে গান্ধীজী পরোক্ষভাবে বিরোধিতা করা সত্ত্বেও সুভাষ বসু জয়লাভ করেন।
১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের ত্রিপুরা কংগ্রেস নির্বাচনে সভাপতির পদে প্রতিযোগিতায় প্রাথমিকভাব অংশগ্রহণ করেন মৌলানা আজাদ, পট্টভি সিতারামায়া এবং সুভাস বসু। গান্ধীজী পট্টভি সিতারামায়াকে সমর্থন করায় মৌলানা আজাদ নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান এবং পট্টভি সিতারামায়াকে সমর্থন করেন। এই সময় কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির অধিকাংশই পট্টভি সিতারামায়া-এর স্বপক্ষে নগ্নভাবে সমর্থন জানান। এতকিছুর পরেই সুভাস বসু জয়লাভ করেন। নির্বাচনের ফলাফল ঘোষিত হয়েছিল ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের ৩০শে জানুয়ারি। এই নির্বাচনে সুভাস বসু পেয়েছিলেন ১৫৭৫ ভোট, আর পট্টভি সিতারামায়া পেয়েছিলেন ১৩৪৬ ভোট। নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের পর, গান্ধীজীর এক বিবৃতিতে জানান, “…পট্টভি সিতারামায়ার পরাজয় আমারই পরাজয়।…হাজার হোক সুভাষবাবু দেশের শত্রু নন!…তাঁর জয়লাভে আমি আনন্দিত।”
যেহেতু নগ্নভাবে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির অনেক সদস্যই পট্টভি সিতারামায়া-কে সমর্থন করেছিলেন। ওয়ার্কিং কমিটির সাথে সুভাষ বসুর দ্বন্দ্ব মিটিয়ে ফেলার জন্য, সুভাষ বসু ১৫ই ফেব্রুয়ারি গান্ধীজীর সাথে দেখা করার জন্য সেবাগ্রাম যান। প্রাথমিকভাবে গান্ধীজী এই দ্বন্দ্ব মিটিয়ে দেওয়ার পরিবর্তে বলেন― সুভাষ ইচ্ছা করলে তাঁর মনোমত নতুন ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করতে পারেন। পরে গান্ধীজী দ্বন্দ্ব মিটিয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু সেটাও ছিল ছলনাপূর্ণ। তারপরেও তিনি অপর এক বিবৃতিতে বলেন― ‘আমাকে স্বীকার করতেই হবে যে, গোড়া থেকেই আমি তাঁর (সুভাষের) পুননির্বাচনের সম্পূর্ণ বিরোধী ছিলাম। এর কারণ আজ আমি বলতে চাই নে।‘ সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর, ২২শে ফেব্রুয়ারি ওয়ার্কিং কমিটির প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। এই সভায় ব্যক্তিগত কাজের অজুহাতে গান্ধীজী যোগদান করেন নি। আর স্বাস্থ্যগতকারণে ডঃ নীলরতনের পরামর্শে সুভাষ বসু অনুপস্থিত থাকেন। ফলে সুভাষ বসু ছাড়াই সভার কাজ শুরু হয়। একরম বিনা কারণেই, এই সভায় ১২ জন ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য পদত্যাগ করেন । এই সভায় শেষ পর্যন্ত গান্ধীর সমর্থকদের নিয়ে কমিটি তৈরি হয়েছিল।
২১ এপ্রিল সুভাষ বসু সুস্থ হয়ে কলকাতায় ফেরেন। নিখিল ভারত রাষ্ট্রীয় সমিতির অধিবেশনে যোগাদানের জন্য কলকাতায় গান্ধীজী আসেন ২৭ এপ্রিল। ২৮ এপ্রিল ওয়েলিংটন স্কোয়ারে অনুষ্ঠিত এই অধিবেশনে গান্ধীজীর এবং সুভাষ বসুর ভিতর দীর্ঘ আলোচনা হয়, কিন্তু গান্ধীজী কংগ্রেস সভাপতি সুভাষ বসুর বিরুদ্ধেই থেকে যান। শেষ পর্যন্ত সুভাষ বসু পদত্যাগ পত্র জমা দেন এবং সাথে সাথে গৃহীত হয়। এরপর নতুন সভাপতি নির্বাচিত হন- গান্ধীজীর প্রিয়ভাজন বাবু রাজেন্দ্রপ্রসাদ। এরপর থেকে কংগ্রেসের সাথে ক্রমান্বয়ে তাঁর বিরোধ হতে থাকে। ৪ঠা জুন গান্ধীজী একটি নির্দেশনায় সারাদেশে সত্যগ্রহ আন্দোলন বন্ধ করে দেন। শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় কমিটি একটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে জানালেন যে, ‘গুরুতর নিয়ম-শৃঙ্খলা ভঙ্গের জন্য শ্রীযুক্ত সুভাষচন্দ্র বসুকে বঙ্গীয় প্রাদেশিক রাষ্ট্রীয় সমিতির সভাপতির পদের অযোগ্য বলিয়া ঘোষণা করা হইল এবং ১৯৩৯ সালের আগষ্ট মাস হইতে তিন বৎসরের জন্য তিনি কোনো নির্বাচিত কংগ্রেস কমিটির সদস্য হইতে পারিবেন না।’
এর ভিতরে ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের ৩ মে তারিখে সুভাষ বসু অল ইন্ডিয়া ফরওয়ার্ড ব্লক (All India Forword Block) নামক একটি দল গঠন করেন। ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের ১লা সেপ্টেম্বর জার্মান বাহিনীর পোল্যান্ড আক্রমণের মধ্য দিয়ে থেকে শুরু হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। সুভাষ বসু এই সুযোগে তীব্র আন্দোলনের মাধ্যমে ভারতের স্বাধীনতাকে ত্বরান্বিত করার উদ্যোগ নেন। পক্ষান্তরে যুদ্ধকালীন সময়ে ব্রিটিশদের পক্ষে থাকার পথ অবলম্বন করেন গান্ধীজী।
ইতিমধ্যে তিনি ব্রিটিশের শত্রু হিসেবে জার্মান, ইতালি, রাশিয়া ইত্যাদি দেশের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল এই সব দেশের সহায়তায় সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে ভারত স্বাধীন করা। এই সব রাষ্ট্রের সাথে পূর্বে কোনো যোগাযোগ না করেই, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, তিন ভারত থেকে পালানোর উদ্যোগ নেন। এক্ষেত্রে তাঁকে বিশেষভাবে সাহায্য করেছিল পাঞ্জাবের কীর্তি কিষাণ পার্টি এবং উত্তর-পশ্চিম ভারতের ফরওয়ার্ড ব্লকের সদস্যরা। ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ জানুয়ারি দিবাগত রাত ১ টা ২৫ মিনিটে পশ্চিমী মুসলমানী পোশাকে তিনি তাঁর এই গোপন যাত্রা শুরু করেন। এই যাত্রায় তিনি তাঁর শিশির বোসকে সাথে নিয়ে মোটর গাড়ি করে কলকাতা ত্যাগ করেন।এই সময় তিনি ছদ্ম নাম নেন মৌলবী জিয়াউদ্দিন। এরপর সুভাষ বসুকে কাবুল পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া দায়িত্ব নেন ভগৎ সিং।
নেতাজী এরপর অনেক পথ ঘুরে কাবুল হয়ে রাশিয়ার রাষ্ট্রদূতের সাথে দেখা করেন। কিন্তু রুশ-রাষ্ট্রদূত তাঁকে কোনও সাহায্য করলেন না। বিফল হয়ে তারপর সুভাস বসু জার্মান দূতাবাসে গিয়ে রাষ্ট্রদূতের সাথে দেখা করলেন। জার্মান রাষ্ট্রদূত তাঁকে আশ্বাস দিলেও বার্লিনের অনুমতি লাগবে বলে জানালেন। ইতিমধ্যে সুভাষ বসুর অন্তর্ধানের সংবাদ সবাই জেনে গেছে। এরপর জার্মান এ্যাম্বেসীর নির্দেশক্রমে এঁরা ইতালির রাষ্ট্রদূত এ্যালবার্ট কোরানীর সাথে দেখা করেন। ১৭ মার্চ সিনর অরল্যান্ডো ম্যাজোট্টা নামে ইতালির পাসপোর্ট নিয়ে সুভাষ বোস কাবুল ত্যাগ করেন। তিনি প্রথমে মস্কো আসেন। সেখানে তিনি সোভিয়েত রাশিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান স্ট্যালিনের সাথে দেখা করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন, পরে তিনি মস্কো থেকে রোমে আসেন এবং ২৮ মার্চ তিনি রোম থেকে বার্লিন পৌঁছান। তিনি বার্লিনে মুক্ত ভারতীয় কেন্দ্র (Free India Center) গড়ে তোলেন।
১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে সুভাষ বসুর অন্তর্ধানের কারণে, সমগ্র ভারতে ফরওয়ার্ড ব্লক-কে নিষিদ্ধ করা হয় এবং ফরওয়ার্ড ব্লকের সকল রাজনৈতিক অফিস বন্ধ করে দেওয়া হয়। এছাড়া ফরওয়ার্ড ব্লক-এর নেতাকর্মীদের পুলিশি নজরাদারিতে রাখা হয়। জার্মানীতে গিয়ে তিনি ভারতের স্বাধীনতার জন্য তিনি জার্মান চ্যান্সেলর এডলফ হিটলারের সাহায্য প্রার্থনা করেন। কিন্তু, জার্মানি কিছু সাহায্য করলেও, ভারতের স্বাধীনতার ব্যাপারে হিটলারের উদাসিনতা তার মনোবল ভেঙ্গে দেয়। ফলে ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দে সুভাষ বসু জার্মান ত্যাগ করেন। একটি জার্মান সাবমেরিনে চড়ে তিনি ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দের ২ জুলাই সিঙ্গাপুরে পৌছান।
ইতিমধ্যে ভারতীয় অপর একজন নেতা রাসবিহারী বসু, প্রবাসে একটি সেনাবাহিনী গড়ে তুলেছিলে। এই বাহিনীর নাম ছিল― ভারতীয় জাতীয় সেনাবাহিনী (INA=Indian National Army) । প্রেসিডেন্ট বিপ্লবী রাসবিহারী বসু সভায় দাঁড়িয়ে, সুভাষচন্দ্র বসুর সাথে আনুষ্ঠানিকভাবে পরিচয় করিয়ে দেন। সেই সঙ্গে প্রবাসী সরকারের নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে সুভাষ বসুকে স্থলাভিষিক্ত করার প্রস্তাব করেন। শেষ পর্যন্ত সবাই এই প্রস্তাব গ্রহণ করলে, সুভাষ বসু প্রবাসী সরকার এবং আজাদ হিন্দ ফৌজের সর্বাধিনায়ক পদ লাভ করেন। উল্লেখ্য রাসবিহারী বসুর গড়া এই বাহিনীতে একটি আলাদা নারী বাহিনী (রানি লক্ষ্মীবাঈ কমব্যাট) ছিল। সব মিলিয়ে এই বাহিনীতে প্রায় ৮৫,০০০ হাজার সৈন্য ছিল। এই বাহি্নীর কর্তৃত্ব ছিল প্রাদেশিক সরকারের হাতে, যার নাম দেওয়া হয় “মুক্ত ভারতের প্রাদেশিক সরকার” (আরজি হুকুমাত-ই-আজাদ হিন্দ)। এই সেনাবাহিনী ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’ নামে সর্বাধিক পরিচিত।
এরপর সবটাই অনেকটা রূপকথার বীরের গল্প । ১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ মার্চ ব্রিটিশ বাহিনীকে পরাজিত করে ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’ ইম্ফল ও কোহিমার পথে অগ্রসর হয়। ২১ মার্চ ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’ ভারতভূমির মনিপুরে প্রবেশ করে। এই ফৌজের কার্যাবলী খুব দ্রুত ভারতব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। যুদ্ধের শেষ দিকে জাপান আত্মসমর্পণ করলে, সুভাষ বসু এই বাহিনী প্রত্যাহার করেন। পরে তিনি এই বাহিনী ভেঙে দেন। ১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দে ফরমোসার তাইহোকু বিমান বন্দরে বিমান দুর্ঘটনায় তিনি মৃত্যবরণ করেন। যদিও এখনও অনেকেই মনে করেন নেতাজীর মৃত্যু হয়নি । তবে ঘটনা যাই হোক, নেতাজী যে চিরকাল প্রতিটি ভারতবাসীর হৃদয়ে অমলিনভাবে বেচে থাকবেন এ বিষয়ে কোন সংশয় নেই ।