পিরিয়ড যা নিয়ে আমাদের দেশের মেয়েরা লজ্জায় থাকে। এমনকি পিরিয়ডের সময় স্নানে সাবান, শ্যাম্পু ব্যবহার করায়ও বিরত থাকে। পিরিয়ডে গ্রামের মহিলারা স্বাস্থ্যসম্মত সামগ্রী ব্যবহার না করে অপরিচ্ছন্ন কাপড় ব্যবহার করে। যা মানুষের সামনে বের করতেও চায় না। পিরিয়ডকে ধরা হয় একটি মেয়ে মহিলার জন্য অন্যায়। পিরিয়ডের সময় শরীর থেকে অনেকটা রক্ত বের হয়ে যায় এজন্য এই সময় প্রয়োজন বিশেষ খাবার ও বিশেষ ভাবে জীবন যাপন করা।

প্রতি চন্দ্রমাস পরপর হরমোনের প্রভাবে পরিণত মেয়েদের জরায়ু চক্রাকারে যে পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যায় এবং রক্ত ও জরায়ু নিঃসৃত অংশ যোনিপথে বের হয়ে আসে তাকেই ঋতুচক্র বলে। মাসিক চলাকালীন পেট ব্যথা, পিঠ ব্যথা, বমি বমি ভাব হতে পারে। আর এই মাসিক ঋতুচক্র/রজ:স্রাব প্রতি মাসে হয়। এটাই হচ্ছে পিরিয়ড। পিরিয়ডের সময় যেসকল খাবার শরীরের জন্য উপকারি তা আজকে আমরা আলোচনা করব-

পিরিয়ড

শাকসবজি : শাকসবজি প্রত্যেকটি মানুষের নিয়মিত খাদ্য তালিকায় থাকা উচিত আর পিরিয়ডের সময় শরীরকে প্রয়োজনীয় সুরক্ষা দিতে সবুজ শাকসবজি খাওয়া যেতে পারে।বিশেষ করে কচু শাক বেশি উপকারী। সবুজ শাকসবজিতে রয়েছে আয়রন এবং ভিটামিন-বি ও উচ্চ ফাইবার। এই ফাইবার আপনার হজম প্রক্রিয়াকে তরান্বিত করবে, যা পিরিয়ডকে সহনীয় করতে খুবই প্রয়োজন।

ক্যালসিয়ামযুক্ত খাবার : ক্যালসিয়াম যুক্ত খাবার এসময় খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ক্যালসিয়াম যুক্ত খাবারগুলো পেশী ব্যথা, পেট ব্যথা দূর করে দেয়। দুধ, দুধ জাতীয় খাবার, ডিম এই সময় খাওয়া উচিত।

পানি : প্রত্যেকটি মানুষের শরীরে পানির গুরুত্ব অপরিসীম। একথা ভুলে গেলে চলবে না যে কেবল রক্তপাত নয়, সেই সাথে শরীর হারাচ্ছে অনেক খানি তরল। আর এই অভাব পূরণ করতে পান করতে হবে প্রচুর পানি। না, পানীয় নয়। সাধারণ পানি। চা, কফি, কোলা ইত্যাদির চাইতে অনেক বেশী স্বাস্থ্যকর সাধারণ পানি। হালকা কুসুম গরম পানি পান করতে পারেন, এতে পেট ব্যথায় আরাম হবে।

মাছ : বিশেষ করে সামুদ্রিক মাছে থাকে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন, মিনারেল, ফ্যাটি এসিড ইত্যাদি। এবং এগুলো পিরিয়ড চলাকালীন শরীরের ক্ষয় পূরণ করে এবং ব্যথা কমাতেও ভূমিকা রাখে। পিরিয়ডের সময় মাছ খেতে ভুলবেন না যেন। সামুদ্রিক মাছ খেলে আরও ভালো। স্যামন, টুনা, কাজুবাদাম যেকোন সামুদ্রিক মাছে প্রচুর পরিমাণে ওমেগা থ্রি রয়েছে। এক গবেষণায় দেখা গেছে যেসব নারীরা প্রতিদিন ৬ গ্রাম ফিস অয়েল বা মাছের তেল গ্রহণ করেন তাদের পিএমএস সংক্রান্ত সমস্যা অনেক কম হয়ে থাকে।

কলা : কলায় প্রচুর পরিমানে পটাশিয়াম থাকে। মাসিকের দিনগুলিতে কলা খেতে ভুলবেন না একেবারেই। কলা পটাশিয়ামের ও ভিটামিনের খুব ভালো উৎস, যা মাসিকের সময় আপনার জন্য জরুরী। এই কলা মাসিকের বিষণ্ণতা কমাতেও সহায়ক। তাছাড়া পিরিয়ডের সময় অনেক নারীই ডায়রিয়াতে ভুগে থাকেন, যা দূর করতে সাহায্য করবে এই কলা।

লাল মাংস : মহিলাদের পিরিয়ডের সময় শরীরে আয়রনের ঘাটতি দেখা দেয়। পিরিয়ডের সময়ে আয়রনের ঘাটতি পূরণ করতে পারে লাল মাংস। চর্বি ছাড়া লাল মাংস অবশ্যই রাখুন খাবারের তালিকায়, সাথে রাখুন প্রচুর সালাদ। শরীর থাকবে সুস্থ।

বাদাম ও বীজ জাতীয় খাবার : বাদাম ভর্তি নানান রকম ভিটামিন ও মিনারেলে যা পিরিয়ডের সময় শরীরের জন্য ভালো। তবে খেয়াল রাখবেন, বাজারের বাড়তি লবণে ভাজা বা চিনিতে জড়ানো বাদাম খাবেন না। চীনা বাদাম, কাজু বাদাম, কাঠ বাদাম, পেস্তা, আখরোট ইত্যাদি তো খেতে পারেনই। সাথে বীজ কুমড়ার বীজ সহ নানা ধরণের বীজ রাখতে পারেন খাবারের তালিকায়। ম্যাগনেসিয়াম, পটাসিয়ামযুক্ত খাবার পেশী টান, পেট ব্যথা কমাতে সাহায্য করে। কুমড়োর বিচি, মিষ্টি আলু পটাসিয়ামের অন্যতম উৎস।

ডার্ক চকলেট: পিরিয়ডের সময় প্রতিদিন কয়েক টুকরো ডার্ক চকলেট হতে পারে আপনার জন্য দারুণ উপকারী। ডার্ক চকলেটে চিনি নেই, ফলে ওজন বাড়বে না। বরং আছে প্রচুর ম্যাগনেসিয়াম। এই চকলেট পিরিয়ড চলাকালীন বিষণ্ণতাও দূর করবে।

হোল গ্রেন : পিরিয়ডের সময় এই জাতীয় খাবার খেলে একদিকে যেমন শারীরিক ক্ষমতা বাড়ে, তেমনি যন্ত্রণাও কমে। আসলে হোল গ্রেনে রয়েছে প্রচুর মাত্রায় কার্বোহাইড্রেট, যা কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা বাড়ায়। সেইসঙ্গে পিরিয়ডের সময়কার ক্ষিদের জ্বালাও মেটায়।

ফাইবার রয়েছে এমন খাবার: ফাইবার নানাভাবে শরীরের উপকারে লেগে থাকে। যেমন ধরুন, দেহের ওজন কমাতে ফাইবার সমৃদ্ধ খাবারের কোনও বিকল্প নেই বললেই চলে। আর যদি পিরিয়ডের সময়কার কথা বলেন, তাহলে বলতেই হয় যে এই সময় শরীরের নানাবিধ কষ্ট কমাতে ব্রকলি, অ্যাভোকাডো, জাম এবং ডালের মতো ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। তাই পিরিয়ডের সময় যদি স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে চান, তাহলে ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার খেতে ভুলবেন না যেন!

পিরিয়ডের সময় যেসকল খাবার এড়িয়ে যাবেন

পিরিয়ড চলাকালীন যেমন শরীরে কিছু খাবার অতিরিক্ত প্রয়োজন তেমনি হরমোণের ক্ষরণ, পিরিয়ড কালীন কষ্ট কমানর জন্য কিছু খাবার এড়িয়ে যাওয়া উচিত। যেসকল খাবার পিরিয়ডের সময় এড়িয়ে যাওয়া ভাল তা নিয়ে আমরা আলোচনা করব।

পিরিয়ড

দুধ, চিজ বা দই : পিরিয়ডের সময় দুধ, চিজ বা দইয়ের মতো ডেইরি প্রডাক্ট বেশি মাত্রায় খেলে বিশেষ কিছু হরমোনের ক্ষরণ এত মাত্রায় বেড়ে যায় যে শারীরিক কষ্ট মাত্রা ছাড়াতে সময় লাগে না। তাই এসময় দুধ এবং তা থেকে বানানো খাবার যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে।

জাঙ্ক ফুড : জাঙ্ক ফুড খাওয়া শরীরের পক্ষে ভাল নয়। আর এই সময় এমন খাবার খেলে তো আরও বিপদ! পিরিয়ডের সময় ফ্রায়েড খাবার খেলে শরীরের মারাত্মক ক্ষতি হয়।

লবণ : লবণ যা শরীরের জন্য উপকারি আবার কাচা লবণ ডেকে আনতে পারে ক্ষতি। পিরিয়ডের সময় বেশি মাত্রায় লবণ রয়েছে এমন খাবার, যেমন ধরুন ফ্রেঞ্চ ফ্রাই জাতীয় পদ বেশি পরিমাণে খেলে শরীরে এমন কিছু পরিবর্তন হতে শুরু করে, যার প্রভাবে পিরিয়ডকালীন কষ্ট আরো বেড়ে যায়। তাই মাসের এই নির্দিষ্ট সময়ে যতটা সম্ভব কম পরিমাণে লবণ খাবেন।

শসা : পিরিয়ডের সময় শসা খেলে নানা ধরনের শারীরিক সমস্যা হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। শসায় উপস্থিত কিছু উপাদান এই সময় শরীরের উপর খারাপ প্রভাব ফেলে।

খালি পেট : খালি পেট সবসময়ই খারাপ আর পিরিয়ডের সময় খালি পেটে একেবারেই থাকবেন না। এই সময় যেহেতু মাত্রতিরিক্ত পরিমাণে এনার্জি লস হয়, তাই এই ঘাটতি পূরণের ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করাটা জরুরি।

কোল্ড ড্রিঙ্ক : পিরিয়ডের সময় কোল্ড ড্রিঙ্ক একেবারে খাবেন না। একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, এই সময় এই ধরনের পানীয় খেলে ইউটেরাইন ওয়ালে রক্ত থেকে যায়। এমনটা হতে থাকলে ৫-১০ বছর পরে গিয়ে ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বহুগুণে বেড়ে যায়।

খাবারের পাশাপাশি পিরিয়ড চলাকালীন সাধারণত যে ভুলগুলি বেশিরভাগ লোক করে থাকেন। এ ভুলগুলো এড়িয়ে গেলে আপনার জীবন হতে পারে সুস্থ

ব্যথা নাশক ঔষধ গ্রহণ : পিরিয়ডের সময় স্বাভাবিক নিয়মে হওয়া ব্যথা বা ক্র্যাম্প নিরাময়ের জন্য মেয়েরা অনেকক্ষেত্রেই নানা ওষুধের সাহায্য নেন। পেন রিলিফের এই ওষুধ বা ইঞ্জেকশনে যে স্টেরয়েড থাকে, তা শরীরের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর। বেশ কয়েকটি ওষুধ সমস্যা কমানোর পরিবর্তে আরও বাড়িয়ে দিতে পারে। আর স্টেরয়েডবহীন অ্যান্টি ইনফ্লামেটরি ড্রাগ আপনার শরীরে আচমকা হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেবে। প্রতিনিয়ত এ ধরনের ওষুধ খেলে তার মারাত্মক প্রভাব পড়তে পারে কিডনি ও লিভারের উপরও।

দীর্ঘক্ষণ প্যাড না বদলানো : চাকরি বা কাজ করা মহিলারা দীর্ঘ সময় প্যাড পাল্টান না। যত বেশি সময় ধরে আপনি একটি প্যাড ব্যবহার করবেন, তত বেশি তাতে ব্যাকটেরিয়া জমা হবে। অনেকেই কাজের চাপে বা অবহেলায় দীর্ঘক্ষণ একই স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করে থাকেন। এটা শরীরের পক্ষে অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর। প্রতি ৪-৬ ঘণ্টা অন্তর অন্তর প্যাড বদলানো উচিত।

সুগন্ধীযুক্ত প্যাড ব্যবহার : কোনো উগ্র বা উত্‍‌কট গন্ধ কারোই পছন্দ না হওয়াটা স্বাভাবিক। তবে তাই বলে সুগন্ধীযুক্ত স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করাটা ঠিক হবে না। এ ধরনের কেমিক্যাল ইনফেকশন ছড়াতে পারে, ব্যাকটিরিয়া তৈরি করতে পারে। সুগন্ধীযুক্ত প্যাডে এমন কিছু সিন্থেটিক কেমিক্যাল যুক্ত থাকতে পারে, যা হয়ে উঠতে পারে ক্যান্সারপ্রবণ।

পর্যাপ্ত ঘুমের অভাব : ব্যথা, ক্র্যাম্পিং, হরমোলান ভারসাম্যহীনতা ও অস্বস্তির কারণে পিরিয়ড চলাকালীন ইনসমনিয়া দেখা দেয় মেয়েদের মধ্যে। ঘুম আসতে চায় না। তবে, এই বিশেষ সময়টায় পর্যাপ্ত ঘুমের অভাব শরীরকে আরও অসুস্থ করে দেয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া ও ঘুম হলে পিরিয়ড অনেক সহজ ও কম কষ্টকর হয়।

শরীরচর্চা : শরীরচর্চা সবসময়ই চিকিৎসকের পরামর্শে করা উচিত আর পিরিয়ডের সময় অল্প বিস্তর শরীরচর্চা চলতে পারে। কিন্তু ইনটেন্স ওয়ার্কআউট করা একেবারেই চলবে না। আর যদি পেটে এবং পিঠে ব্যথা থাকে, তাহলে তো একেবারেই শরীরচর্চা করা যাবে না।

রাত জাগা : পিরিয়ডের সময় রাত জাগলে শরীরের কাজ করার ক্ষমতা একেবারে কমে যায়। সেইসঙ্গে আরও অসুস্থ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও বৃদ্ধি পায়। শুধু তাই নয়, ঘুম না হওয়ার কারণে ক্লান্তিভাব এতটাই বেড়ে যায় যে দৈনন্দিন কাজ কর্মেও বাঁধা আসতে শুরু করে। তাই পিরিয়ডের সময় রাত জাগা একেবারেই চলবে না।

চা-কফি : পিরিয়ড চলাকালীন ক্লান্তি, ঘুমের অভাব, মাথাব্যথার মতো শারীরিক সমস্যাগুলি থাকায়, মাঝে মধ্যেই কফি খেতে মন চায়। কারণ ক্যাফেন শরীরকে ডিহাইড্রেট করে এই সময়টায় উল্টে শরীরের ক্ষতি করে দিতে পারে। বাড়িয়ে দিতে পারে মাথাব্যাথা। মাসিকের সময় চা-কফি যত বাদ দেবেন, ততই টেনশন, নিদ্রাহীনতা, উদ্বেগের মতো সমস্যাগুলি কম হবে।

সুরক্ষিত যৌন জীবন : পিরিয়ডের সময় যোনিতে ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। কাজেই নিজের সুরক্ষার কথা মাথায় রেখে এই সময়টায় সঙ্গমে লিপ্ত হলে পর্যাপ্ত সুরক্ষার দিকটা মনে না থাকলে, তা হতে পারে মারাত্মক।

কাপড়ের ব্যবহার আর নয় : এখনও গ্রাম-গঞ্জ, শহরতলি এমনকী শহরেও অনেক মেয়ে মাসিকের সময় কাপড়ের ব্যবহার করেন। এটি একেবারেই স্বাস্থ্যকর নয়। তাই সবসময় কাপড়ের পরিবর্তে হাইজেনিক প্যাড ব্যবহার করুন।

Mr. Shuva is a News and Content Writer at BongDunia. He has worked with various news agencies all over the world and currently, he is having an important role in our content writing team.

Leave A Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.