চাণক্য নীতি বাংলায় – Chanakya niti Bengali

 

চাণক্য নীতি বাংলায় – Chanakya niti Bengali: আমরা সবাই কোন না কোন সময়ে,  ভেবে বা না ভেবে,  ভুল করে হলেও অনেক সময় সমাজের স্বার্থপর, লোভী, খারাপ মানুষদের সাথে, বা  তাদের বাইরের রূপ অথবা ব্যবহার দেখে বন্ধুত্ব করি । কিন্তু আমাদের ভুল তখন ভাঙ্গে, যখন তারা আমাদের ক্ষতি করে । আমাদের বোকা বানিয়ে চলে যায় । আমরা ভাবি এটা যদি আগে বুঝতে পারতাম, এই মেয়েটির বা ছেলেটির আসল রূপ এত নোংরা, তাহলে হয়তো আমাদের এতটা কষ্ট, এতটা ক্ষতি হত না । কিন্তু চিন্তা করার কিছু নেই, মহামতি চাণক্য এমন কিছু নীতি, এমন কিছু পদ্ধতি বলে গেছেন, যদি সেই নীতি বা পদ্ধতিগুলি মন দিয়ে বুঝে, নিজেদের জীবনে ব্যবহার করতে পারা যায়, তাহলে সেই সমস্ত ভালো মানুষের মুখোশধারী লোকগুলোকে খুব সহজেই চিহ্নিত করা যায় এবং সেটি মাত্র কয়েক সেকেন্ডেই । যদি আমরা সেই মুখোশধারী মানুষদের চিনে ফেলতে পারি, তাহলে তারা আমাদের কোনভাবেই ঠকাতে পারবে না । আর যদি আপনি কোন জায়গায়, যে কোন কাজে কখনো না ঠকেন, তাহলে সফলতা আপনার  হাতের মুঠিতে আসতে বাধ্য । আমাদের চলার রাস্তায়, অজানা শত্রু আমাদের অজান্তে কোন ক্ষতি করতে পারবে না । এক কথায় বলা ভাল, চাণক্যের এই নীতি বা জ্ঞান বর্তমান সময়ের জন্য খুব উপযোগী ।

আমরা সকলেই কম বেশী জানি আচার্য চানক্যর কথা । আচার্য চানক্য অনেক শাস্ত্রে পন্ডিত ছিলেন । তার পাণ্ডিত্যের এবং বলা ভাল তার ক্ষুরধার বুদ্ধির জন্য চন্দ্র গুপ্ত মৌর্য একজন সাধারন নাগরিক থেকে একদিন মগধের সিংহাসনে বসেন । আচার্য চানক্যর অনেক গুলি লেখা শাস্ত্রের মধ্যে একটি হলো সমুদ্রশাস্ত্র বা সমুদ্র নীতি । শোনা যায়, আচার্য চানক্য এমন একজন বুদ্ধিমান মানুষ ছিলেন যে, তিনি রাস্তায় চলতে চলতে বা সামনের কারো সাথে কথা বলতে বলতে, সেই মানুষটির মনে কি চলছে, সেই মানুষটি কি ভাবছে, সে সমস্ত কথা একবারে বুঝে ফেলতে পারতেন । শুধু তাই না, অপর ব্যাক্তি ধোকাবাজ না জ্ঞানী বা জ্ঞানী হওয়ার ভান করেছে, এই সমস্ত কিছু বুঝে ফেলতেন ।আচার্য চানক্যর নীতিগুলি একবার পড়ে দেখলে আমরাও আচার্য চাণক্যের অবাক করা পদ্ধতিগুলি ব্যবহার করে, যেকোনো মানুষের আসল চেহারার খোঁজ লাগাতে পারি ।

চাণক্য নীতি বাংলায় – Chanakya niti Bengali

আচার্য চাণক্যের লেখা থেকে প্রথমে জানতে হবে, আমাদের চারপাশে মুখোশধারী মানুষ গুলো কেমন ? আচার্য চানক্যর লেখা থেকে এখানে ছয় প্রকার মানুষের কথা বলা হয়েছে । যাদের থেকে আমাদের দূরে থাকা উচিত । আমরা সহজেই তাদের কিভাবে চিনতে পারব ? সেই পদ্ধতি জানাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ । আমরা যেকোনো মানুষের আসল রূপ কয়েক সেকেন্ডে কিভাবে চিনে ফেলতে পারব ?

 

  • মানুষ সম্পর্কে প্রথম নীতিতে চাণক্য এটা বলেছেন, সোনা কতটা খাঁটি তা বোঝার জন্য, সোনা ঘষে দেখতে হয়, পুড়িয়ে সোনা গরম করে বা পিটিয়ে, এমন কি কেটেও দেখতে হয় । ঠিক সেভাবে একটা মানুষের আসল চেহারা আমরা তখনই দেখতে পারব, যখন আমাদের জীবনে কোন বড় সমস্যা  চলে আসবে । চাণক্যের মতে, একজন বন্ধুর পরিচয় তখনই হয়, যখন আমরা কোন সমস্যায় পড়ি । কারণ, যে সত্যিকারের বন্ধু হয়, সে ভগবান কৃষ্ণের মতো হয় । সে আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি সময়ে আমাদের পাশে থাকে । আর যারা সুবিধাবাদী বন্ধু হয়, তাদের সুবিধার জন্য দেখা যায়, আমরা বিপদে পড়লে আমাদের ওই বিপদের মধ্যে ফেলে রেখে যাবে সবার প্রথমে ।

চাণক্য নীতি বাংলায় – Chanakya niti Bengali

  • ঠিক সেইভাবেই একজন স্ত্রীর পরিচয় সত্যিকার ভাবে তখনই জানা যাবে, যখন টাকা বা ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স শেষ হয়ে কেউ দেউলিয়া হয়ে পড়বে । কারণ, আচার্য চানক্যর মতে, একজন আদর্শ স্ত্রী, পিতা-মাতার মত হয় । যে তার স্বামীর সুখ আর দুঃখের সময় সমান ভাবে সাথী থাকেন । আর তা  না হয়ে, যদি স্বার্থপর ও লোভী স্ত্রী হয়, তাহলে ষে বিপদের সময়, তার স্বামীকে বিপদের মধ্যে ফেলে, তাকে ছেড়ে অন্য কারো হাত ধরে চলে যেতে পারে ।

চাণক্য নীতি বাংলায় – Chanakya niti Bengali

  • আচার্য চানক্যর  সমুদ্রনীতির প্রথম সূত্রটি আরো গভীরে বুঝতে হলে, আচার্য চানক্যর উদাহরণটা পড়ে দেখতে হবে । চাণক্য বলেছেন, যে কারণে বিষাক্ত সাপে ভরা কোন কক্ষে থাকা উচিত না, ঠিক সেই কারণে, প্রচন্ড রাগী, লোভী স্ত্রী এবং স্বার্থপর বন্ধুর সাথে থাকা বিপদজনক এবং এদের সাথে থাকা একদমই উচিত না । কারণ এই সমস্ত লোক, কোন না কোন সময়, যেকোন ভাবে, আপনার জীবনকে সাপের বিষের মতই বিষাক্ত করে তুলতে পারে ।

চাণক্য নীতি বাংলায় – Chanakya niti Bengali

  • পরের নীতিতে আচার্য চাণক্য বলেছেন, যে ব্যক্তি নিজের বাবা-মাকে মিথ্যে কথা বলে ঠকাতে পারে, সে সময়কালে , আমাদের মিথ্যে কথা বলে ঠকাতে দুবার ভাববে না । এরকম চরিত্রের ব্যক্তি তার ভালো এবং লাভের আশায় যে কোন ব্যক্তির ক্ষতি করতে পারে । এই নীতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে চাণক্য বলেছেন, আমাদের এরকম লোকেদের সঙ্গ সব সময় এড়িয়ে চলতে হবে । কারণ এরকম নোংরা লোক হয়ত আমাদের সামনে, মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে বিশ্বাস অর্জন করছে কিন্তু সময়কালে সে ঠিক মিথ্যা কথা, তার ভাল মানুষের মুখোশ খুলে ফেলে মিথ্যা কথা বলে আমাদের বোকা বানাবে এবং ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে । তাই আমাদের উচিৎ এধরনের লোক দের সঙ্গ এড়িয়ে চলা ।

চাণক্য নীতি বাংলায় – Chanakya niti Bengali

  • একজন মানুষ সত্যিকার প্রেমী তখনই হয়, যখন সে  তার প্রেমের জন্য সব কিছু করতে পারে । এমনকি নিজের জীবনকে পর্যন্ত তুচ্ছ ভাবতে পারে । যেমন ধরা যেতে পারে একটা মৌমাছি । একটা কালো মৌমাছির যা শক্তি আছে, তাতে সে শক্ত জিনিস ভেদ করতে সক্ষম । কিন্তু সেই মৌমাছি যখন একটা পদ্মফুলে আটকে যায় এবং সেখান থেকে বের হবার ক্ষমতা থাকলেও সে বের হয় না । দেখা যায়, সে নরম ফুলের পাপড়ি ছেড়ে বেরোতে পারছে না । এর কারণ হলো, সে জলাশয়ের ফুটে থাকা পদ্মফুলটিকে অনেক ভালোবাসে । যার কারণে সে চায়না এই সুন্দর ফুলের কোন ক্ষতি হোক । সে ভাল করেই জানে, এভাবে আটকে থাকলে তার মৃত্যু ঘটতে পারে । কিন্তু সে তার প্রাণের পরোয়া না করে, তার ভালোবাসার জন্য নিজের প্রান ত্যাগ করতেও রাজি আছে । ঠিক সেইভাবে, যে ব্যক্তি তার জীবনের জন্য ত্যাগের ভাবনার আছে, সেই ব্যক্তি আপনাকে সত্যিকারে ভালোবাসে । এরকম চিন্তার মানুষ কখনো আপনার বিশ্বাস ভাংবে না । তবে এটাও ঠিক প্রেমের জন্য জীবন দিয়ে দেওয়া কখনই উচিত না । আত্মহত্যা একটা নিকৃষ্ট কাজ এবং এই মহা পাপের কাজ একদমই করা ঠিক না । চানক্য, এখানে নিজের জীবন দিতে না, জীবন দিয়ে দেওয়ার মত  ভাবনার কথা বলেছেন । মানে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, নিজের প্রাণের চেয়েও আপনি আপনার প্রেমিক বা প্রেমিকাকে ভালবাসুন ।  পাশাপাশি  অপরদিকে এমন মানুষ রয়েছেন, যারা ভালোবাসা বলতে শুধু শরীর বোঝে, তাদেরকে আপনার চিনতে হবে । নয়তো এমন এক দিন আসবে,  যখন তারা দেখবে, টাকা পয়সা নেই আপনার কাছে, এবং আপনি তার বা তাদের  চাহিদা পূরণ করতে অক্ষম, তখন সে বা তারা একবারের জন্য আপনার কথা না ভেবে আপনাকে ফেলে চলে যেতে একবারও ভাববে  না । এই প্রকার মুখোশধারী মানুষ থেকে দূরে থাকুন এবং কাছে টেনে নিতে হবে ঠিক তাদের, যাদের ভেতর সুন্দর, মন সুন্দর ।

চাণক্য নীতি বাংলায় – Chanakya niti Bengali

  • পরবর্তী নীতিতে আচার্য চানক্য বলেছেন, একটা চন্দন কাঠকে যতই ছোট ছোট টুকরো করে কেটে ফেলা হোক না কেন, তার সুগন্ধ কখনোই শেষ হবেনা । সেভাবেই জ্ঞানী ব্যক্তির জীবনে যত সমস্যা আসুক না কেন, তার ভাল গুন এবং সংস্কার কখনো শেষ হয় না । অন্যদিকে একটা কাককে যতই স্নান করানো হোক না কেন, সে কখনোই ফর্সা হবে না । একটা মদের বোতল যতই কেটে ফেলুন না কেন,  সেটা কখনোই পবিত্র হবে না । সেভাবেই যে ব্যক্তির মাথায় শুধুই নোংরা চিন্তা রয়েছে, বদ মতলবে তার চিন্তা ভাবনা ভর্তি রয়েছে, সেই ব্যক্তিকে শত বার স্নান করানো হলেও পবিত্রও হবে না । তাকে যতই হাজারবার বোঝান হোক না কেন, সে কখনো ভালো চিন্তা করতে পারবে না । আপনি যদি এরকম বাজে চিন্তা ধারার লোকেদের সাথে বন্ধুত্ব করে থাকেন, তাহলে একশত ভাগ নিশ্চিত থাকুন, সেই ব্যাক্তি তার খারাপ চিন্তা ভাবনা তার সঙ্গীর মাথাতেও ধীরে ধীরে  ভরিয়ে দেবে ।

চাণক্য নীতি বাংলায় – Chanakya niti Bengali

  • পরবর্তী নীতি সম্পর্কে চানক্য তার শাস্ত্রে বলেছেন, যে ব্যক্তির চরিত্র ভাল এবং সংস্কারি হয়, সে শত কাঁটার মধ্যে থেকেও ফোটা পদ্মের মতো হয় । সে তার সুগন্ধ চারপাশে ছড়িয়ে দেয় ।  অপরদিকে শয়তান এবং দুষ্ট লোক একটি গোলাপ ফুলের মধ্যে থাকা কাটার মত হয় । যারা এত সুন্দর সমাজে থেকেও তাদের খারাপ কাজ করেই যায় । তাই আচার্য চাণক্য আরো বলেছেন, মানুষকে তাদের ধর্ম, জাতি দিয়ে নয়, তাদের কর্ম ও চরিত্র দিয়ে চিনতে হবে । বুঝতে হবে একটা কাক যতই উঁচু টিলার উপর উঠে বসুক না কেন, সে কখনোই ঈগল হতে পারবে না । সেরকম একটা লোক কতটা মহান,  সেটা তার ভালো সংস্কার ও চরিত্র ঠিক করে । চাণক্য বলেছেন, আমাদের দুষ্টু লোকদের তাদের কর্ম থেকে এবং তাদের সাথে জড়িতদের চিহ্নিত করতে হবে । তাদের ধর্ম ও জাতি দেখে নয় ।

চাণক্য নীতি বাংলায় – Chanakya niti Bengali

  • শেষ প্রকার মানুষটি কেমন হবে,  তার একটা বাস্তব উদাহরণ দিলেই বঝা যাবে । ধরে নিন, এক শহরে একজন পেইন্টার বা চিত্রকর ছিলেন এবং আরও ধরে নিন তার নাম ছিল সমীর । তিনি ভাবলেন ভালো একটা ছবি আকবেন । অনেক চেষ্টা করে, তিনি একটা ভালো পেইন্টিং বা ছবি আঁকলেন । তিনি মনে মনে  ভাবলেন আমার পেইন্টিংটা কেমন হল, তা যদি সবাই এসে বলে এবং কি কি ভুল রয়েছে তা যদি আমাকে ধরিয়ে দেয়, তাহলে আগামী দিনে আরো ভালো পেইন্টিং করতে পারব । এটা ভেবে, সমীর তার আঁকা ছবি বা সেই পেইন্টিংটিকে রাস্তার মোড়ের সামনে রাখলেন এবং ছবির নিচে লিখে দিলেন, এই পেন্টিং-এ কি কি ভুল হয়েছে তা সবাই যেন দেখে । তারপর এভাবে ছবিটি রেখে দিয়ে, এক ঘন্টা পর ফিরে দেখলেন, তার পুরো পেইন্টিং-এ নানান আকি বুকিতে ভরা । কারণ সবাই এসে যে যার ইচ্ছা মত, সেই পেইন্টিং এর প্রতিটি জায়গায় দাগিয়ে রেখেছে । যাই হোক ছবিটিকে এই অবস্থায় দেখে মনে মনে সমীরের খুব কষ্ট হল এবং ভাবলেন, তিনি হয়তো সত্যি সত্যি পেইন্টিং টা ভাল আঁকতে পারেন নি । পরের দিন সমীর আবার আরো ভালো একটা পেইন্টিং রেডি করলেন । আগের বারের মত তিনি এটাকে আবার মোড়ের মাথায় রেখে দিয়ে এলেন এবং আবারও ছবির নিচে একই কথা লিখে দিয়ে এলেন । পরদিন তিনি মোড়ের মাথায় তার রাখা ছবিটি দেখতে গেলেন । গিয়ে অবাক হয়ে দেখলেন, আগের দিনের থেকেও আরও বেশি কাটাকুটিতে তার ছবিটি ভরে আছে ।

প্রচণ্ড মন খারাপ নিয়ে এবং রাগে কাঁপতে কাঁপতে সে দিন সমীর বাড়ি ফিরলেন । এমন সময় তার একজন বন্ধু তাকে সেই অবস্থায় দেখে কারণ জানতে চাইল । সমীর তাঁর বন্ধুকে সব কথা খুলে বললেন এবং শেষে বললেন, পেন্টিং আমার দ্বারা হবে না । আমি আজ থেকে এই আঁকা আঁকির কাজ ছেড়ে দিচ্ছি । এটা শুনে বন্ধুটি বলল, তুই শেষ আরেকটা পেইন্টিং তৈরি কর ।  সমীর জিজ্ঞেস করল, আবার কেন ? তখন তাঁর বন্ধু উত্তর দিল, পরে বলছি ।ভাই  তুই শুধু শেষবারের মতো একটা পেইন্টিং আঁক । সমীর আর কোন কথা না বাড়িয়ে,  আবার ছবি আঁকতে রাজী হলেন, এবং পরদিন অনেক সময় নিয়ে আরো ভালোভাবে একটা ছবি এঁকে তার বন্ধুর হাতে ধরালেন  এবং বললেন, এই নে তোর পেন্টিং । এইবার বল, কেন বানাতে বললি ?  বন্ধুটি কিছু না বলে  ছবিটি হাতে নিল এবং বলল, চল এবার আমার সাথে । সমীরকে সাথে নিয়ে সেই বন্ধুটি ঠিক সেই মোড়ে নিয়ে গেল, যেখানে আগের দুই দিন সমীর ছবি রেখে এসেছিলেন ।

অতপর, বন্ধুটি, পেইন্টিংটি রাস্তার মোড়ে রেখে, সমীরকে বলল,  তার নিচে লিখে দিতে যে, ‘এই পেইন্টিং-এ একটি ভুল রয়েছে । কি ভুল রয়েছে তা খুঁজে বার করুন এবং সংশোধন করে দিন’ । এ কথা লিখে,  তারা দুজনেই বাড়ি ফিরে গেল । পরদিন যখন তারা পেইন্টিং এর সামনে এল তখন আরো অবাক হয়ে গেল । পেইন্টিং আগের মতই রয়েছে এবং তাতে কোন দাগ নেই । অর্থাৎ, ছবিটিতে কোথায় ভুল আছে সেটা দেখিয়ে পরিবর্তন করতে বলা হয়েছিল । ফলে ছবিটিতে কেউ সামান্যতম পরিবর্তনও করেনি ।
বন্ধুটি এবার সমীরকে বলল, তোর আগের পেইন্টিং-এ কেবলমাত্র ভুল ধরতে বলা হয়েছিল । তখন সবাই নানান ভুল বার করেছিল এবং অপরের ভুল ধরতে খুব মজা হচ্ছিল তাদের । কিন্তু, পাশাপাশি যখন সেই লোকদের, ভুলগুলো শোধরাতে বলা হয়, তখন, কেউই একটা দাগ দেবার সাহস পায়নি ।

এটা থেকে আমরা শিখলাম, আমাদের জীবনেও এমন অনেক লোক রয়েছেন, যারা আমাদের ভুলগুলিই কেবলমাত্র ধরে থাকে, কিন্তু, সেই ভুল গুলি শোধরাবার কথা একবারের জন্যেও বলে না । বরং তারা এটাই  সব সময় বলে, ‘তুই এটা পারবি না’, ‘তোর এটা করার ক্ষমতা নেই’, ‘তুই এটা করা ছেড়ে দে’, ‘এসব করে কি হবে?’  ইত্যাদি কথা । এরকম লোকদের কাজই হলো মানুষের ভুল ধরা, মানুষকে ডিমোটিভেট করা । তাই এরকম ক্ষতিকর লোকেদের নিজের জীবন থেকে বাইরে ফেলে দিতে হবে । পাশাপাশি বন্ধুত্ব এমন লোকদের সাথে করতে হবে, যে আপনার কাজের মর্ম বোঝে ।

চাণক্য নীতি বাংলায় – Chanakya niti Bengali

 

  • আচার্য চানক্য প্রথম নীতিতে বলেছিলেন, সোনা  কতটা খাঁটি, সেটা বোঝার জন্য আমাদের ৪ টি কাজ করতে হবে । এই চারটি কাজ হল, সোনা ঘষে দেখতে হবে, সেটাকে কেটে দেখতে হবে, আগুনে পুড়িয়ে ফেলতে হবে এবং সোনাকে পিটিয়ে পরীক্ষা করে দেখা । যদি সোনা খাঁটি না হয়ে থাকে, তাহলে এই চারটি কাজে সেটা ধরা পড়ে যাবে । সেই ভাবেই, কোন ব্যক্তিকে চিনতে হলে, তাকে সে রকম চারটি পরীক্ষার মধ্যে চেনা সম্ভব । এই চারটি জিনিস বা পরীক্ষা কি তা বোঝার জন্য, একটা গল্প শোনা যাক ।

চাণক্য নীতি বাংলায় – Chanakya niti Bengali

  • “একটি ছেলের বিয়ে হতে চলেছে । বিয়ের আগে, সে তার বন্ধুদের ব্যাচেলার পার্টি দিয়েছিল । তাঁর সাথে যে মেয়েটির বিয়ে হতে চলেছে, সেই মেয়েটিও পার্টিতে উপস্থিত ছিল । সেই মেয়েটি ছিল এক নজরকাড়া সুন্দরী এবং ওই ছেলেটি তার প্রেমে পাগল ছিল । যাই হোক সেই ব্যাচেলর পার্টিতে যে জায়গায় খাবার তৈরি হচ্ছিল, সেখানে হঠাৎ আগুন লেগে যায় । দেখতে দেখতে আগুন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় । সবাই এ দিক ওদিক ছোটা ছুটি করছে । এরই মধ্যে আচমকা মেয়েটি চিৎকার করে কেঁদে উঠল । কারণ, যেখানে আগুন লেগেছিল, ঠিক তার পেছন ঘরে মেয়েটির গয়নার বাক্স রাখা ছিল ।

ছেলেটির সামনে গিয়ে মেয়েটি চিৎকার করে বলল, যদি সে সত্যিকারে তাকে ভালবাসে, তবে তার গয়নার বাক্সটা যেন এনে দেয় । সেই ছেলেটি অর্থাৎ তার হবু স্বামী মেয়েটির সমস্ত কথা শুনল এবং তারপর আগুনের দিকে তাকাল এবং আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ল । কিছু সময় পর ছেলেটি  সত্যি সত্যি সেই গয়নার বাক্সটা নিয়ে এল । বাক্সটা নিয়ে আসার পর,  সেটি মেয়েটির হাতে দিয়ে সেই ছেলেটি বলল, এই নাও তোমার বাক্স । কিন্তু আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারবো না । এখন আপনাদের কাছে প্রশ্ন, সেই ছেলেটি এমন কেন বলল ? মেয়েটির হয়তো তাই প্রশ্ন ছিল । তাই তো ছেলেটি উত্তর দিল, যার কাছে তার স্বামীর থেকে, তার গয়না অনেক দামী, কিভাবে সারা জীবন এমন মেয়ের সাথে সংসার করবে সে ।

গল্পটি পড়ে দেখা  যাচ্ছে, সেই ছেলেটি মেয়েটিকে প্রকৃত ভালোবাসে। তাই নিজের প্রাণের তোয়াক্কা না করে মেয়েটির প্রিয় গয়নার বাক্সটা ফিরিয়ে  নিয়ে আসে । কিন্তু সেই ছেলেটি এতটা বোকা না যে, এমন মেয়ের সাথে সারাটা জীবন কাটাবে । ভবিষ্যতে হয়ত এর থেকেও বড় কোন বিপদে পড়লে, মেয়েটি ছেলেটিকে ফেলে চলে যেতে পারে । সেই ছেলেটির মতন যদি কোন গুন কোন মানুষের মধ্যে থাকে, তাহলে তাকে কখনোই হাতছাড়া করবেন না । আর মেয়েটির মতন, যার সামান্য সোনার গয়না ত্যাগের ভাবনা, তার হবু স্বামীর থেকে বেশি হয়, সেরকম ব্যক্তিদের থেকে এক হাত নয়, দশ হাত দূরে থাকুন । সুতরাং দেখা যাছে, কারো ভাবনা দিয়ে  মানুষ চিহ্নিত করা সম্ভব ।

একই ভাবে আরও একটা গল্প শোনা যাক । একবার এক ব্যাক্তি, যার নাম ধরে নিন সঞ্জয় । একদিন সঞ্জয় তার আর এক বন্ধু – যার নাম ধরে নিন অমিতাভ, তার কাছে গেল । সঞ্জয়কে দেখতে তখন খুব মনমরা লাগছিল । বন্ধুকে মনমরা দেখে, অমিতাভ জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে ভাই ? তখন সঞ্জয় বললো, “আমি আমার স্ত্রীকে একদমই বিশ্বাস করি না” । তখন বন্ধুটি কারণ জানতে চাইলে সঞ্জয় বললো, “আরে ধুর, আমি আমার স্ত্রীকে ফোন করেছিলাম এবং জিজ্ঞেস করেছিলাম সে কোথায় ? তখন সে বলল, সে তার প্রতিবেশী বউদির বাড়িতে আছে ।“ তখন বন্ধুটি বলল, ”এতে বিশ্বাস না করার কি আছে ? প্রতিবেশির বাড়িতে আছে, সে তো ভালো কথা” ।
তখন উত্তরে সঞ্জয় বললো, আরে আমি তো  সেই বৌদির সাথে তখন ছিলাম” ।
পাঠক হাসছেন নিশ্চয়ই । গল্পটির হাসির হলেও এটাই আজকের বাস্তব সমাজের কালো সত্যি । আর এটাই হল সেই তৃতীয় জিনিস, যা আপনাদের পরীক্ষা করতে হবে । আর তা হলো মানুষের চরিত্র । যে সমস্ত মানুষের চরিত্রে কোন দাগ নেই তারা সবার থেকে ভালো । আর যদি কারো চরিত্রের দাগ থাকে, তার চরিত্র  যদি দূষিত থাকে, তাহলে, তার থেকে দূরে থাকাই ভালো । এই গল্পের সঞ্জয় এবং তার স্ত্রী দুজনের চরিত্রের দাগ রয়েছে । তাই তাদের দুজনের থেকে দূরে থাকা ভালো ।

চাণক্য নীতি বাংলায় – Chanakya niti Bengali

  • তো চলুন অপর পরীক্ষা হয়ে যাক, আরেকটা মজার গল্প দিয়ে ।
    এক বন্ধু বিয়ে করবে বলে ঠিক করল । যথারীতি একদিন একসাথে চারটি মেয়ের সাথে দেখা করল । চারটি মেয়ের মধ্যে একজন ভাল রান্না পারে, দ্বিতীয় মেয়েটির ব্যবহার খুব ভাল । তৃতীয় মেয়েটি খুবই জ্ঞানী এবং চতুর্থ মেয়ে টি একটু আজব ধরনের । ছেলেটি এই চতুথ মেয়েটি সম্পর্কে বিশেষ কিছু বুঝতেই পারেনি । চারজনের সাথে কথা বার্তা বলার পর কিছুক্ষণ ভেবে সে বন্ধুটি বলে, আমি চতুর্থ মেয়েটিকে বিয়ে করব । তার সাথে অপর যে বন্ধু ছিল, সে এর কারণ জানতে চাইল । তখন সে উত্তর দিল, এই মেয়েটি সম্পর্কে কিছু জানতে না পারলেও, ও বেশ সুন্দরী । আচার্য চাণক্য বলেছেন, কোন ব্যক্তি কে বুঝতে হলে তার গুণ গুলিকে দেখো । কিন্তু আমরা উপরে সৌন্দর্য দেখে সব ভুলে যাই । অনেকেই রয়েছেন, যারা বন্ধু বানাবার সময় তাদের রূপ, তাদের টাকা, শিক্ষা প্রভৃতি দেখে । কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, তারা ভুলে যায় দেখতে হলে অপরের গুণটাকে আগে দেখা উচিৎ । লোকের বাইরেটা যতই সুন্দর হোক না কেন , তাদের যদি ভালো গুণ না থাকে, তাহলে তাদের থেকে দূরে থাকাই শ্রেয় । খারাপ কাজ করা মানুষ তার আশেপাশে থাকা লোকেদের উপর খারাপ প্রভাব ফেলে ।

এগুলো হলো সেই চারটি জিনিস, যা চানক্য বলে গেছেন । যার  উপর ভিত্তি করে, পরীক্ষা করে আপনারা অনায়াসেই আপনার আশে পাশে ঘুরে বেড়ানো মানুষদের সহজে চিনতে পারবেন , নিজে থেকেই বিচার করে দেখতে পারবেন, তার সাথে মিশবেন বা বন্ধুত্ব করবেন কি করবেন না ।

Kajal Paul is one of the Co-Founder and writer at BongDunia. He has previously worked with some publishers and also with some organizations. He has completed Graduation on Political Science from Calcutta University and also has experience in News Media Industry.

Leave A Reply