খেজুর মানব সভ্যতায় যে সকল ফল পাওয়ায় যায় তার মধ্যে অন্যতম সুমিষ্ট ফল । ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় অনেক বছর ধরেই খেজুর চাষের তথ্য মেলে। ইসলাম ধর্মের প্রেক্ষাপটে হযরত মুহাম্মদ (স:) এর প্রিয় ফলের মধ্যেেএটি একটি। তাই খেজুর খাওয়াকে সুন্নত হিসাবে ধরা হয়। এ ফলটি প্রধানত: মরু এলাকায় জন্মে। মরুভূমির কাটাজাতীয় উদ্ভিদের ফল হলেও খেজুর দেশের সর্বত্রই পাওয়া যায়। তবে এলাকাভিত্তিক খেজুরের আস্বাধের পার্থক্য আছে। ধারণা করা হয় পারস্য উপসাগরের তীরের সবদেশগুলোতে খেজুরের চাষাবাদ দিয়ে শুরু হয়। মিশরের অধিবাসিরা খিস্ট্র জন্মের ৪০০০ হাজার বছর পূর্বে খেজুর সম্পর্কে জানত। মদজাতীয় পানীয় তৈরি করতো এ ফল দিয়ে। খিস্ট্রের জন্মের ৬০০০ হাজার বছর আগে পূর্বাঞ্চলীয় আরবে খেজুরের চাষাবাদের তথ্য মেলে। পাকিস্তানের মেরগড়, হরপ্পা সভ্যতায় খেজুরের চাষাবাদের তথ্য মেলে। ১৯৫৯ সালে লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলীতে সর্বপ্রথম আর্ন্তজাতিক খেজুর সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।

বাংলাদেশের খেজুরের আবার বহুল ব্যবহার রয়েছে। রস দিয়ে পিঠা, পায়েস গুড় তৈরি হয়। আবার খেজুরের পাতা দিয়ে পাটি তৈরি করা হয়। লোকজ সংস্কৃতিতে খেজুর গাছের রয়েছে অপরিসীম গুরুত্ব। গাছ কাটার আগে তাকে সুন্দর করে ছালা হয়। খেজুর গাছ ছালার সময় যে আবর্জনা তৈরি হয় তাকে ফ্যাতরা বলা হয়। এ ফ্যাতরা জ্বালানীর কাজের পাশাপাশি লোকজ উৎসব বুড়ির কুটোতে বোন্দা ঘুরাতে ব্যবহার করা হয়। লোক সাহিত্যে তাই খেজুর গাছ ও রসের ব্যবহার অনেক বেশী। কথিত আছে ‘খালি কলসি রেখে দিলে ভরে যায় রসে, সেই রসে দিয়ে জ্বাল মন ভরে সুবাসে’। আবার গাভীর সাথে তুলনায় বলা হয় ‘মাইট্যা গোয়াল কাঠের গাই-বাছুর ছাড়া দুধ পাই’। কাকডাকা ভোরে খেজুরের রস, মন মাতানো ঘ্রাণ শহরে বিরল। শীতের সাকালে খেজুর রস, মিষ্টি রোদ, কৃষক-কৃষাণির হাসি দারুণ প্রাণশক্তি। কবির ভাষায়, ‘এমন শীতলমিষ্টি কোথা আছে নীর? পান মাত্র তৃষিতের জুড়ায় শরীর’। তাই এ গাছকে অনেকে শখের বসে ‘মধুবৃক্ষ’ বলে থাকে। খেজুরের রস ও পিঠার সাস্কৃতিক সম্পর্ক রয়েছে। রস দিয়ে হরেক রকম পিঠার ইতিহাস ও ঐতিহ্য রয়েছে। পিঠা ও রসের নানা রেসিপি শিরনি-পায়েস, ঘনরসে চিতৈ পিঠা, খেজুর গুড়-নারকেল মিশ্রণে বেশ সুখ্যাতি রয়েছে। ঝোলা গুড়, পাটালি গুড়, নলেন গুড়,  ভেলি গুড়, বালুয়া গুড়, মিছরি গুড়, বেশ সুস্বাদু ও সুপরিচিত। গাছে নলি দেয়ার প্রথম দিকের রস থেকে তৈরি গুড়কে নলেন গুড় বলে। পাটালি গুড়ের কদর এখনও বিদ্যমান। গুড় বিক্রির অর্থনৈতিক উপযোগিতা রয়েছে। পরিকল্পিত উপায়ে দেশের চাহিদা পূরণ করে বিদেশে গুড় রপ্তানির ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে।

খেজুর

গাছ কাটায় শীতকালে গাছিরা মাটির পাত্র তৈরি করে তাকে কোন অঞ্চলে হাড়ি বা ঠিলে বলা হয়। গাছের পাতা দিয়ে রকমারি হাত পাখা, লছমি, ঝাড়–, ঝুড়ি, থলে, ছিকা ও নানা রকম খেলনা তৈরি করা হয়। সর্দি-কাশি নিরাময়ে খেজুর ফল উপাদেয়। খেজুরের পাতা রোগ নিরাময়ে ব্যবহার হয়ে থাকে। হৃদরোগ, জ্বর ও উদরের সমস্যা সমাধানে বেশ কার্যকর। গাছের শিকড় দাঁত ও মাড়ির প্রদাহ নিবারণে ব্যবহৃত হয়। রস মুখে রুচি আনে। ঠিলে ধুয়ে দে বউ গাছ কাটিতে যাবো গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য। খেজুর গাছ যারা কাটে তাদের গাছি বলা হয়। খেজুর গাছের গাছিদের গৃহিনীরাও সারাদিন খেজুর রস ও তার উপকরণ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। গাছ তোলা বা চাছার জন্য দা ধার দিতে বালি কচা লাগে। খেজুর গাছের রস যে নলি দিয়ে আসে তাকে চোংও বলা হয়। দড়ি, কাছি, ঠুঙ্গি নিয়ে যত ব্যস্ততা গাছি সম্প্রদায়ের। শীতকালে গাছিদের কদরও বেড়ে যায়। বাংলা সাহিত্যেও তাই খেজুর তার অপরুপ রুপে ধরা দিয়েছেছে। “বসেছে বালিকা খুর্জ্জুরছায়ে নীল দরিয়ার কূলে” জীবনান্দ তার স্বভাববশতই গ্রামের বালিকাকে খেজুর বনে দেখেছেন। গ্রামে একসময় খেজুরের বিচিকে সুপারির বিকল্প হিসাবে ব্যবহার করা হত। বেয়াই সাহেবের সাথে মজা করতেও গাছের কাটা ব্যবহারের ছড়া প্রমাণ করে খেজুর মানুষের কতটা কাছের। এ গাছকে কেন্দ্র করে জায়গার নামও কম নয়। খেজুরবাগান থেকে খাজুরিয়া শহর বা গ্রামে নামের প্রমাণ মেলে। খেজুর গাছের মাঝে পাতার সাথে একটি অতিরিক্ত অংশ থাকে যা রক্তপাত ঠেকাতে কাজ করে। আরব দেশ আরে একটু এগিয়ে তারা খেজুরকে বেহেশতি ফল হিসাবে অভিহিত করেছেন। খেজুরের ঐতিহাসিক ভূমিকার পাশাপাশি শরীরের জন্য রয়েছে এমিনো এসিড, প্রচুর শক্তি, শর্করা ভিটামিন ও মিনারেল। শরীরের এই প্রয়োজনীয় গ্লুকোজের ঘাটতি পূরণ করতে সাহায্য করে। চলুন আজ আমরা জেনে নিই খেজুরের পুষ্টিগুণ-

কোলেস্টেরল এবং ফ্যাট: অতিরিক্ত কোলেস্টেরল বা বাড়তি পরিমাণে চর্বি থাকে না। ফলে খেজুর খেলে শরীরের অন্যান্য ক্ষতিকর ও চর্বি জাতীয় খাবার থেকে দূরে থাকতে পারবেন।

প্রোটিন: প্রোটিন মানুষের শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় অত্যাবশ্যকীয় একটি উপাদান। প্রোটিন সমৃদ্ধ। ফলে পেশী গঠন করতে সহায়তা করে এবং শরীরের জন্য খুব অপরিহার্য প্রোটিন সরবরাহ করে।

ভিটামিন : এ ফলে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন যা শরীরের জন্য অত্যাবশ্যক। যেমন, বি১, বি২, বি৩ এবং বি৫। এছাড়াও ভিটামিন এ১ এবং সি ভিটামিন পাওয়ার আরও একটি সহজ মাধ্যম হচ্ছে খেজুর। দৃষ্টি শক্তি বাড়ায়। সেই সঙ্গে রাতকানা রোগ প্রতিরোধেও খেজুর অত্যন্ত কার্যকর।

স্মৃতিশক্তি সতেজ রাখতে সাহায্য করে: স্মৃতিশক্তি সতেজ রাখে খেজুর। খেঁজুরের মধ্যে রয়েছে ফসফরাস। এটি মস্তিষ্কের জন্য ভালো। পটাশিয়াম থাকায় হৃদস্পন্দন ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে।

আয়রন : আয়রন মানব দেহের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। প্রচুর আয়রন রয়েছে। ফলে এটা হৃৎপিন্ডের কার্যমতা বাড়ায়। তাই যাদের দুর্বল হৃৎপিন্ড, তাদের জন্য খেজুর হতে পারে সবচেয়ে নিরাপদ ওষধ।

খেজুর

মুটিয়ে যাওয়া রোধ: মাত্র কয়েকটি খেজুর ক্ষুধার তীব্রতা কমিয়ে দেয় এবং পাকস্থলীকে কম খাবার গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করে। অল্পতেই শরীরের প্রয়োজনীয় শর্করার ঘাটতি পূরণ করে।

ক্যালসিয়াম : ক্যালসিয়াম হাড় গঠনে সহায়ক। প্ররচুর পরিমাণ ক্যালসিয়াম রয়েছে যা হাড়কে মজবুত করে। শিশুদের মাড়ি শক্ত করতে সাহায্য করে।

ক্যানসার প্রতিরোধ : খেজুর পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ এবং প্রাকৃতিক আঁশে পূর্ণ। নিয়মিত এ ফলটি খেলে ক্যানসারে ঝুঁকি কম থাকে। Abdominal ক্যান্সার রোধে কার্যকর ভুমিকা পালন করে ।

মায়ের বুকের দুধ: বুকের দুধ খাওয়ানো মায়েদের জন্য এ ফল সমৃদ্ধ এক খাবার, যা মায়ের দুধের পুষ্টিগুণ আরো বাড়িয়ে দেয় এবং শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।

কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে : এ ফলে আছে এমন সব পুষ্টিগুণ। যা খাদ্য পরিপাকে সাহায্য করে। এবং কোষ্ঠকাঠিন্য রোধ করে। কখনও কখনও ডায়রিয়ার জন্যেও এটা অনেক উপকারী।

শিশুদের রোগবালাই: এ ফল শিশুদের মাড়ি শক্ত করতে সাহায্য করে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ডায়রিয়াও প্রতিরোধ করে। তাই শুধু রমজান মাসে কেন, বছরজুড়েই খাদ্যতালিকায় থাকুক ।

সংক্রমন : যকৃতের সংক্রমনে এ ফল উপকারী। এছাড়া গলা ব্যথা, বিভিন্ন ধরনের জ্বর, সর্দি, এবং ঠাণ্ডায় খেজুর উপকরী। অ্যালকোহল জনিত বিষক্রিয়ায় বেশ উপকারী। ভেজানো অবস্থায় খেলে বিষক্রিয়ায় দ্রুত কাজ করে।

রক্তশূন্যতা রোধ করে : প্রচুর মিনারেল সঙ্গে আয়রন থাকার কারণে খেজুর রক্তশূন্যতা রোধ করে। তাই যাদের হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ কম তারা নিয়মিত খেজুর খেয়ে দেখতে পারেন।

কর্মশক্তি বাড়ায় : এ ফলে প্রচুর পরিমাণে প্রাকৃতিক চিনি থাকার কারণে খেজুর খুব দ্রুত শক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। সারাদিন রোজা রাখার পর রোজাদাররা যদি মাত্র ২টি খেজুর খা্ন তবে খুব দ্রুত কেটে যাবে তাদের ক্লান্তি।

স্নায়ুতন্ত্রের কর্মক্ষমতা বাড়ায় : এ ফল নানা ভিটামিনে পরিপূর্ণ থাকার কারণে এটি মস্তিষ্কের চিন্তাভাবনার গতি বৃদ্ধি রাখে, সঙ্গে স্নায়ুতন্ত্রের কর্মক্ষমতা বাড়ায়। একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ছাত্র-ছাত্রী যারা নিয়মিত এ ফল খায় তাদের পারফরম্যান্স অন্যদের তুলনায় ভাল থাকে।

হৃদরোগ প্রতিরোধ করে : এ ফলে রয়েছে পটাশিয়াম যা বিভিন্ন ধরণের হৃদরোগ প্রতিরোধ করে এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায়। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে,  শরীরের খারাপ ধরণের কোলেস্টেরল কমায় (LDL) এবং ভাল কোলেস্টেরলের (HDL) পরিমাণ বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।

Mr. Shuva is a News and Content Writer at BongDunia. He has worked with various news agencies all over the world and currently, he is having an important role in our content writing team.

Leave A Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.