আমাদের শরীর একটি মন্দিরের মতো । একটা মন্দিরে যেমন বিগ্রহ থাকে,  সেখানে আমরা প্রতিদিন ভক্তিভরে ভোগ নিবেদন করি,  পূজা-অর্চনা করি ।  তেমনি আমাদের শরীরের ভিতরে যে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আছে,  সেগুলি অনেকটা বিগ্রহ এর মত । সেগুলিকে প্রতিনিয়ত আমাদের যত্ন করতে হবে । যদি আমরা অবহেলা করি তাহলে শরীর খারাপ হতে বাধ্য । বর্তমান যুগে সবচেয়ে বড় সমস্যা পানীয় জলের । আমাদের শরীরের সবচেয়ে কমন অসুখগুলো আসে পানিয়  জল থেকে । আর পানীয়  জল থেকেই আগে ক্ষতিগ্রস্ত হয় আমাদের পেট ।  সারাদিন আমরা বেঁচে থাকার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করি।  নিজেদের জন্য এবং নিজেদের সাথে পরিবারের  কাছের মানুষের মুখে দুবেলা-দুমুঠো খাবার তুলে দেয়ার জন্য  প্রতিনিয়ত বেশিরভাগ মানুষকে লড়াই চালিয়ে যেতে হয় । এই লড়াই চালাতে গিয়ে আমরা নিজের শরীরটাকেই অবহেলা করি বেশি । যার পরিপেক্ষিতে আমাদের শরীরে বাসা বাঁধে নিত্যনতুন অসুখ-বিসুখ । বেশিরভাগ মানুষ কমবেশি পেটের রোগে ভোগেন ।  কারণ বেশি খাওয়া দাওয়া,  পানীয় জলের সমস্যা,  আবার সঠিক সময়ে সঠিক খাবার না খাওয়া ।

কি কারনে জন্ডিস হয়:

রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা বেড়ে গেলে জন্ডিস দেখা দেয়। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে যেসব কারণ জানা গেছে তা জেনে নিই।

লিভার প্রদাহ: লিভার প্রদাহে বিলিরুবিনের উৎপাদন বেড়ে যায়। ফলশ্রুতিতে রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা বেড়ে গিয়ে জন্ডিস সৃষ্টি হয়।

পিত্তনালীর প্রদাহ: পিত্তনালীর প্রদাহে বিলিরুবিন শোষণ ব্যাহত হয়। ফলে বিলিরুবিন বৃদ্ধি পেতে থাকে।

পিত্তনালীর ব্লকঃ পিত্তনালীতে ব্লক হলে লিভার বিলিরুবিন সরাতে ব্যর্থ হয়। বেয়ে যায় জন্ডিসের সম্ভাবনা।

গিলবার্ট’স সিন্ড্রোমঃ এই অবস্থায় এনজাইমের কার্যক্ষমতা কমে যায়। এর ফলে পিত্তের রেচনতন্ত্রে সমস্যা হয় এবং বিলিরুবিনের মাত্রা বেড়ে যায় ।

ডুবিন-জনসন সিন্ড্রোমঃ এই বংশগত রোগে লিভার থেকে বিলিরুবিন শোষণ হতে বাঁধা দেয়। ফলশ্রুতিতে জন্ডিস হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে।

দেহে যকৃতের বিপাকে অংশ নেওয়ার ক্ষমতা সর্বাধিক। দেহে বিলিরুবিনের পরিমাণ প্রতি ডেকালিটারে ২ মিলিগ্রামের থেকে বেড়ে গেলে আমাদের চোখ, হাতের পাতা, এবং মিউকাসের পর্দা হলুদ রঙ ধারন করলে । আমরা বলতে পারি জন্ডিস হয়। আমাদের দেহে লোহিত রক্ত কণিকার অতিরিক্ত ভাঙনই এই রোগের প্রধান উৎসগত কারণ।

লিভারের রোগ জন্ডিসের প্রধান কারণ। আমরা যা কিছুই খাই না কেন তা লিভারে প্রক্রিয়াজাত হয়। লিভার নানা কারণে রোগাক্রান্ত হতে পারে। হেপাটাইটিস এ, বি, সি, ডি এবং ই ভাইরাসগুলো লিভারে প্রদাহ সৃষ্টি হয় যাকে বলা হয় ভাইরাল হেপাটাইটিস। আমাদের দেশসহ সারা বিশ্বেই জন্ডিসের প্রধান কারণ এই হেপাটাইটিস ভাইরাসগুলো। তবে উন্নত দেশগুলোতে অতিরিক্ত মধ্যপান জন্ডিসের একটি অন্যতম কারণ।

এ ছাড়া অটোইমিউন লিভার ডিজিজ এবং বংশগত কারণসহ আরও কিছু অপেক্ষাকৃত বিরল ধরনের লিভার রোগেও জন্ডিস হতে পারে। ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ায়ও অনেক সময় জন্ডিস হয়। তা ছাড়া থ্যালাসিমিয়া ও হিমোগ্লোবিন ই-ডিজিজের মত যে সমস্ত রোগে রক্ত ভেঙ্গে যায় কিংবা পিত্তনালীর পাথর বা টিউমার এবং লিভার বা অন্য কোথাও ক্যান্সার হলেও জন্ডিস হতে পারে। তাই জন্ডিস মানেই লিভারের রোগ এমনটি ভাবা ঠিক নয়।

জন্ডিস হওয়ার সংক্ষিপ্ত  কারণঃ  

  1. জন্ডিস প্রধানত জলবাহিত রোগ।অপরিষ্কার জলপান করলে এই রোগের সম্ভাবনা বাড়ে।
  2. অতিরিক্ত মদ্যপান করলে জন্ডিসের মতো রোগ হয়। কারণ এর ফলে যকৃতে ক্ষতের সৃষ্টি হয়।
  3. জন্ডিসের প্রধান কারণ হিমোলাইসিস। হিমোগ্লোবিনের হিমের বিয়োজন ঘটে।হিমোলাইসিস প্রধানত দেহে জীবানু ঘটিত আক্রমণের ফলে দেখা যায়।
  4. শিশুদের জন্মের সময় লোহিত রক্ত কণিকা গঠন এবং ভাঙনের মধ্যদিয়ে যায় ফলে শিশুদের জন্মের সময় জন্ডিস দেখা যায়।
  5. বেহিসেবী খাদ্যগ্রহণ এই রোগের অন্যতম মূল কারণ।
  6. রিফাম্পিসিনের মতো ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রূপে জন্ডিস দেখা যায়।
  7. এছাড়াও লিভারে টিউমার, লিভারে , অগ্ন্যাশয়ে বিষক্রিয়া ঘটলে জন্ডিসের দেখা মেলে।

জন্ডিসের চিকিৎসা –  Treatment for jaundice

আমাদের দেহ কোটি কোটি কোষ নিয়ে গঠিত কতকগুলি কোষ নিয়ে একটি কলা তৈরি হয়, আবার কতগুলি কলা নিয়ে গঠিত হয় অঙ্গ এবং কতগুলি অঙ্গ একটি তন্ত্র গঠন করে। আমাদের দেহের দরকারি অনেক তন্ত্রের মধ্যে পৌষ্টিক তন্ত্র আমাদের দেহের চালিকাশক্তি প্রদান করে। এই তন্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হল যকৃৎ। আমাদের দেহে পাকস্থলীর পাশে একটু ওপরের দিকে যকৃৎ থাকে। যকৃতের মধ্যে থাকে পিত্তাশয়, পিত্তথলি, পিত্তনালী। পিত্তাশয় থেকে নিঃসৃত পিত্ত আমাদের দেহে পাচিত খাদ্যের অম্লত্বকে নিয়ন্ত্রণ করে। বিভিন্ন ফ্যাট জাতীয় খাদ্যকে এমালসিফায়েড করে তার পাচনে সাহায্য করে। পিত্ত বা বাইলের মধ্যে কোনো উৎসেচক থাকে না,  এর মধ্যে থাকে কিছু রঞ্জক পদার্থ থাকে। বিলিরুবিন, বিলিভারডিন, ইউরোবিলিনোজেন। বিলিরুবিন আমাদের মুত্রের মাধ্যমে দেহের বাইরে নির্গত হয়। বিলিভারডিন আমাদের মলকে তার নিজস্ব রং প্রদান করে।

জন্ডিস প্রধানত পাঁচ প্রকারের হয়,

  1. হেপাটাইটিস এ
  2. হেপাটাইটিস বি
  3. হেপাটাইটিস সি
  4. হেপাটাইটিস ডি
  5. হেপাটাইটিস ই

এর মধ্যে  হেপাটাইটিস বি, হেপাটাইটিস সি, হেপাটাইটিস ডি, হেপাটাইটিস ই এই রোগগুলি প্রাণঘাতী রূপ নেয়।এইসব ক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া অবশ্য কর্তব্য। এইসব ক্ষেত্রে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া উচিত।

হেপাটাইটিস এ জন্ডিসের মূল উপসর্গগুলি হল-

হেপাটাইটিস বি এর লক্ষণ

১) এই রোগের ক্ষেত্রে হাতের পাতা চোখের স্ক্লেরা হলুদাভ বর্ণ ধারন করে।

২) এই সময় বমি বমি ভাব, অবসাদ, খিদের প্রতি অনীহা জন্মায়।

৩) এই রোগের ক্ষেত্রে মুত্রের বর্ণ হলুদ হয়ে যায়, এবং সারা শরীরে দুর্বলতা লক্ষ্য করা যায়।

৪) বিলিরুবিনের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় শরীরে নানা অংশে তার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।

৫) এই রোগের সময় লিভারের আকার বৃদ্ধি পায়।

হেপাটাইটিস বি (ক্রনিক) সাধারণত বংশগত কারণে হয়ে থাকে। হেপাটাইটিস বি, সি, ডি, ই এর ক্ষেত্রে প্রদাহের সৃষ্টি হয়। এবং উপসর্গগুলি খুবই প্রাণনাশী রূপ নেয়।

জন্ডিসের উপসর্গগুলি সম্পর্কে আমরা সবাই অবগত। জন্ডিস নিয়ে আমাদের মধ্যে অনেকরকমের ধারণা থাকলেও, কারণ গুলি আমাদের জানা থাকলে সেই রোগ নিরাময়ের থেকে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারি সহজেই। কারণ কথাতেই আছে, “prevention is better than cure”। তাহলে এখন দেখে নেওয়া যাক কি কি কারণে আমাদের জন্ডিস হতে পারে।

জন্ডিস এর প্রতিরোধ-

এই রোগ প্রতিরোধের একমাত্র উপায় সঠিক সময়ে রোগের নিশ্চিত রূপে  নির্ণয় করলেই এই রোগ নিরাময় সম্ভব।

এছাড়াও খাওয়া দাওয়ার প্রতি যত্নশীল হওয়া উচিত। ডাক্তারের  নিয়মিত রক্ষণা বেক্ষণের মধ্যে থাকতে হবে।

প্রতিকার-

  1. এই রোগের ক্ষেত্রে বিশ্রাম নেওয়া বিশেষ প্রয়োজন। কারণ বিশ্রাম ছাড়া এই রোগ প্রতিকার সম্ভব নয়।
  2. যথা সম্ভব হালকা খাবার খাওয়া, ফলের রস, এবং সহজপাচ্য খাদ্যগ্রহণ করা উচিত।
  3. এই সময় প্যারাসিটামল, অ্যাসপিরিন, ব্যাথার ওষুধ, ঘুমের ওষুধ খাওয়া উচিত নয়। যথা সম্ভব চিকিৎসকের কথা মতো জীবন যাপন করা উচিত।
  4. বেশি করে জল খাওয়া উচিত , এবং আয়রন যুক্ত সব্জি খাওয়া উচিত।
  5. হেপাটাইটিস বি এর টীকা নিলে এই রোগের সংক্রমণ হয় না।
  6. ফ্যাট জাতীয় খাওয়ার ত্যাগ করা উচিত।

 

ডাক্তারের পরামর্শ- এই রোগের ক্ষেত্রে ডাক্তারের রেগুলার চেক আপে থাকা উচিত। এই রোগে ডাক্তারের কথামতো  ওষুধ খাওয়া উচিত। এই রোগ সেরে গেলেও ডাক্তারের কথা মতো চলা উচিত। হেপাটাইটিস বি এর ক্ষেত্রে রোগ সেরে গেলেও প্রদাহের সৃষ্টি হয়। যা ভবিষ্যতে লিভার সিরোসিসের কারণ রূপে দেখা দিতে পারে।

জন্ডিসের প্রকোপ নিয়ে অনেক ধারণা আছে । জন্ডিস  মরণব্যাধি রোগ না হলেও অনেক সময় জন্ডিসের কারনে অনেকেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে । এর কারণ হচ্ছে অজ্ঞতা । তবে বাড়িতে সব সময় নিজেদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে চিকিৎসা না করিয়ে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে সবসময় চিকিৎসা করা বাঞ্ছনীয় ।

Kajal Paul is one of the Co-Founder and writer at BongDunia. He has previously worked with some publishers and also with some organizations. He has completed Graduation on Political Science from Calcutta University and also has experience in News Media Industry.

Leave A Reply