কলকাতার সোনাগাছির ইতিহাস

বং দুনিয়া ওয়েব ডেস্কঃ কলকাতার নিষিদ্ধ পল্লী হিসাবেই পরিচিত “সোনাগাছি” । আসুন জেনে নেওয়া জাক কলকাতার সোনাগাছির ইতিহাস সম্পর্কে। সোনাগাছি ভারতের সবচেয়ে বড় নিষিদ্ধ পল্লী হিসাবে পরিচিত । কথিত আছে প্যারিসের বিখ্যাত যৌনকর্মীরাও কলকাতার এই সোনালি অঞ্চল (Golden district)-এর খ্যাতি সম্পর্কে অবহিত ছিলেন । এই পতিতালয়ের কয়েকশত বহুতল ভবনে প্রায় ১০০,০০০ যৌনকর্মী বসবাস করেন ।  সোনাগাছি উত্তর কলকাতার মার্বেল প্যালেসের উত্তরে চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ, শোভাবাজার ও বিডন স্ট্রিটের সংযোগস্থলের নিকটে অবস্থিত।

সোনাগাছির ইতিহাস সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে বলা ভাল অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙালি বাবু সম্প্রদায় এই অঞ্চলে নিজ নিজ উপপত্নীদের প্রতিপালন করতেন। এই অঞ্চলের বেশ কিছু বাড়ি নির্মিত হয়েছিল ব্রিটিশ যুগে। তবে সোনাগাছির পথ চলা প্রথম শুরু হয়েছিল বোধহয় উনিশ শতকেই। তখন সময় ছিল ইংরেজদের শাসনের । ইতিহাস বলছে গোটা ভারতকেই তখন আস্তে আস্তে দখল করার পথে এগোচ্ছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ব্রিটিশদের জন্য মহানগর কলকাতা তখন এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান । কলকাতা তখন ব্রিটিশরাজের নয়া রাজধানী ।

ব্রিটিশ আমলে কলকাতার গুরুত্ব ছিল অনেক । নতুন নতুন জায়গা দখল করতে এবং সেই নতুন জায়গা শাসন করার জন্য  ইংল্যান্ড থেকে দলে দলে আসতে থাকল কমবয়সী ইংরেজরা । তখন তাদের বয়স কম, শরীরে তরুণ রক্ত। নিজেদের দেশে হয়ত তারা খুব ভাল ছিলেন না বা উন্নত জীবন যাপন করতে পারতেন না, কিন্তু  নতুন দেশে এসে তার জৌলুস দেখে তাঁদের তো চক্ষু চড়কগাছ । চারিদিকে তখন একজন ইংরেজ হিসাবে নানান সুযোগ সুবিধার হাতছানি । নানান ভাবে প্রচুর অর্থ,  ধনদৌলতে শিগগিরই তাদের হাতে আসা শুরু করল । আর কথায় আছে “অর্থ অনর্থের মূল”, বিনা কায়েশে হাতে পাওয়া  নগদ অর্থ পেয়ে  ফুর্তিতে মন দিলেন তাঁরা । 

কলকাতার সোনাগাছির ইতিহাস

কলকাতার সোনাগাছির ইতিহাস

ইংল্যান্ড থেকে আসা তরুণ দের কেউ হয়ত বিয়ে করেননি, আবার করলেও তাদের বু-বাচ্চা সবই তো ইংল্যান্ডে। কী করবেন? অগত্যা এদেশী কালা নেটিভদের বিধবা মেয়েগুলোকে ধরে ধরে আনতে লাগলেন কলকাতার সোনাগাছিতে । খুব সম্ভবত  কলকাতা শহরে বেশ্যাবৃত্তির বোধহয় সেই শুরু । তবে অনেক ইতিহাসবিদের মতে, পূবে কর্ণওইয়ালিস স্ট্রিট ও পশ্চিমে চিতপুরের মাঝের পুরো জায়গাটা নিয়েই  পতিতাদের  উপনিবেশ গড়ে উঠেছিল । আর সবচেয়ে মজার বিষয় হল,  সেই জায়গাটার প্রকৃত মালিক ছিলেন প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর । আর এই উপনিবেশ বা নিষিদ্ধ পল্লীর স্থাপনা হয়েছিল নাকি সেই জমিদার ‘বাবু’র উদ্যোগেই । কারন অনুসন্ধান করলে দেখা গেছে, সেই আমলে বিখ্যাত বাঙ্গালীরা “বাবু” সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন । আর বেশির ভাগ বাবুদের একাধিক উপপত্নী থাকাটা ছিল তখনকার সময়ের “বাবু কালচার” । সেকালের বাবুদের বারবনিতা-বিলাস নাকি ছিল রীতিমতো একটা ব্যাপার। কিন্তু ঘরে পত্নীর সাথে তো আর উপপত্নী রাখা যায় না । সেই সমস্যার কথা মাথায় রেখে “বাবু সম্প্রদায়” তাদের উপপত্নীদের রাখার ব্যবস্থা করলেন বর্তমানের “সোনাগাছি” তে ।

কলকাতার সোনাগাছির ইতিহাস

একটু পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, তখনকার আমলে কলকাতা শহরের বিখ্যাত বড়োলোক ‘বাবু’দের মধ্যে তিনি একজন। তাঁর ও স্থানীয় কয়েকজন ধনী জমিদার ‘বাবু’র উদ্যোগেই নাকি শুরু হয়েছিল সোনাগাছির ব্যবসা । (তখনও অবশ্য সোনাগাছি ‘সোনাগাছি’ হয়নি) । কথিত আছে,  সানাউল্লাহ নামে এক মুসলমান সাধুবাবার  নাম বিখ্যাত ছিল ঐ এলাকায় । পরবর্তী কালে ধীরে ধীরে  একসময় জায়গাটার নাম হয় ‘সোনাগাছি’ । ও সেই নামেই আস্তে আস্তে সোনাগাছি ‘সোনাগাছি’ হয়ে ওঠে।  তারপরে সোনাগাছির এলাকা ক্রমাগত বেড়েছে ।

কলকাতার সোনাগাছির ইতিহাস

এবার জেনে নেওয়া যাক কলকাতার নিষিদ্ধ পল্লী তথা কলকাতার “সোনাগাছি” র সম্পর্কে কিছু তথ্যঃ

  • বর্তমানে কলকাতার সোনাগাছি ভারতের বৃহত্তম ‘নিষিদ্ধ পল্লি’। প্রায় ১০ হাজার যৌনকর্মী এখানে বাস করেন।
  •  কিংবদন্তি অনুসারে, এককালে এই এলাকার মালিক ছিলেন সানাউল্লাহ বা সোনা গাজি নামে এক মুসলমান ধর্মগুরু। সেই গাজির মাজার এখনও এই এলাকায় রয়েছে।
  •  সোনাগাছির যৌনকর্মীদের একটা বড় অংশ আসেন নেপাল আর বাংলাদেশ থেকে।
  •  বাঙালি যৌনকর্মীদের সংখ্যা ক্রমশ কমে আসছে সোনাগাছিতে। নেপালি, রাজস্থানি আর ‘আগ্রাওয়ালি’দের আধিক্য এখন এখানে।
  •  সোনাগাছিতে এক রাত্রের ‘আনন্দে’র জন্য ৩০০ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত খরচ হতে পারে। পারিশ্রমিকের এত বৈচিত্র্য ভারতের আর কোনও ‘নিষিদ্ধ পল্লি’তে বিরল।
  •  সোনাগাছির যৌনকর্মীরা বেশিরভাগই তাঁদের পেশার জগতে পরিচিত হন ছদ্মনামে।
  • সোনাগাছিতে কর্মরত যৌনকর্মীরা সকলেই যে অভাবের তাড়নায় বা অবস্থার চাপে পড়ে এই পেশায় নামতে বাধ্য হন, তা নয়। অনেকেই স্বেচ্ছায় আসেন এই পেশায়।
  • যৌনকর্মীদের কাছে আগত ‘খদ্দের’রা যাতে কন্ডোম ব্যবহার করেন তা সুনিশ্চিৎ করার জন্য ‘সোনাগাছি প্রোজেক্ট’  নামে একটি প্রকল্প শুরু করা হয় ১৯৯২ সালে। (সোনাগাছি প্রকল্প যৌনকর্মীদের সমবায় । এটি এই অঞ্চলের যৌনকর্মীদের মধ্যে কাজ করে তাদের মধ্যে কন্ডোম ব্যবহার ও মানুষ পাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো বিষয়ে সচেতনতার কথা প্রচার করে। ১৯৯২ সালে জনস্বাস্থ্য বিজ্ঞানী স্মরজিৎ জানা এই সংস্থাটি প্রতিষ্ঠা করেন। তবে মুখ্যত যৌনকর্মীরাই এটিকে চালিয়ে থাকেন। এই সংস্থার কৃতিত্ব যৌনকর্মীদের মধ্যে এইচআইভি সংক্রমণের হার ৫ শতাংশে কমিয়ে আনা, যা ভারতের অন্যান্য নিষিদ্ধ পল্লির তুলনায় অনেক কম। সেই জন্য রাষ্ট্রসংঘের এইডস কর্মসূচিতে এটি শ্রেষ্ট অনুশীলন মডেল বা বেস্ট প্র্যাকটিশ মডেল আখ্যাত হয়েছে) 
  • ‘সোনাগাছি প্রোজেক্ট’ প্রকল্পের অংশ হিসেবেই ১৯৯২ সালে “দুর্বার মহিলা সমন্বয় সমিতি” নামে একটি সংগঠন গড়ে ওঠে যৌনকর্মীদের স্বার্থ রক্ষার লক্ষ্য নিয়ে। বর্তমানে এই সংগঠনের সদস্যসংখ্যা প্রায় ৬৫ হাজার। (দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটি (ডিএমএসসি) সোনাগাছি প্রকল্প সহ পশ্চিমবঙ্গের ৬৫,০০০ যৌনকর্মী ও তাদের সন্তানদের নিয়ে বিভিন্ন প্রকল্প পরিচালনা করে থাকে। এই সংস্থা যৌনকর্মীদের অধিকার স্বীকৃতি ও যৌনব্যবসার বৈধীকরণের দাবি জানিয়ে থাকে। এছাড়াও তারা বিভিন্ন শিক্ষা ও কর্মসংস্থানগত কর্মসূচি পালন করে এবং ক্ষুদ্র ঋণ দিয়ে থাকে। বাংলা ভাষায় “দুর্বার” শব্দটির অর্থ অপ্রতিরোধ্য। ডিএমএসসি ভারতের প্রথম জাতীয় যৌনকর্মী সম্মেলনের আয়োজন করে। ১৯৯৭ সালের ১৪ ই  নভেম্বর কলকাতায় আয়োজিত এই সম্মেলনের শিরোনাম ছিল ‘সেক্স ওয়ার্ক ইজ রিয়েল ওয়ার্কঃ উই ডিম্যান্ড ওয়ার্কার্স রাইট’ (‘Sex Work is Real Work: We Demand Workers Rights‘)
  • ১৮৮০ সালে ‘অজ্ঞাতনামা’ লেখকের হাতে রচিত হয় নাটক ‘বেশ্যালীলা’। নাটকটির প্রেক্ষাপট ছিল সোনাগাছি। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত বাংলায় অনেক সাহিত্যই লেখা হয়েছে সোনাগাছির প্রেক্ষাপটে।
  • সোনাগাছিতে বসবাসরত শিশুদের নিয়ে জানা ব্রিস্কি ও রফ কফমান তৈরি করেন ডকুমেন্টারি  ‘বর্ন ইনটু ব্রথেলস: ক্যালকাটাস রেড লাইট কিডস’। ফিল্মটি সেরা ডকুমেন্টারি হিসেবে ২০০৪ সালে অস্কার জেতে।

কলকাতার সোনাগাছির ইতিহাস

ভারতে যৌনব্যবসা আইনমতে নিষিদ্ধ হলেও কিছুদিন আগের এক হিসেব অনুযায়ী প্রায় ১৪০০০ যৌনকর্মী সোনাগাছিতে কাজ করেন। প্রতিবছর প্রায় ১০০০ জন মেয়ে এই ব্যবসায় নতুন যোগ দেন। সম্প্রতি  দেখা গেছে, কলকাতায় সোনাগাছির যৌনকর্মীরা নিজেদের উদ্যোগে তাঁদের এলাকায় দুর্গাপুজোও করছেন। বর্তমানে বেশ কয়েকটি এনজিও ও সরকারি সংস্থা এখানে এইডস সহ যৌনরোগ প্রতিরোধমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।

কলকাতার সোনাগাছির ইতিহাস

তবে এসবের পরেও কিছু কথা থেকে যায় । এত কিছুর পরেও দেখা গেছে,  এখানে যৌনব্যবসার আড়ালে চলতে থাকে আরও নানা বেআইনি ব্যবসা । আর গোটা কলকাতাকে নিজের মতো করে ‘বিনোদন’ জুগিয়েও তাই সোনাগাছিকে থেকে যেতে হয় ব্রাত্য, গোপন ।এখন সেখানকার বাসিন্দারা অন্যদের থেকে আলাদা । প্রায়ই  গোটা কলকাতার মানুষদের থেকে প্রায় দ্বিগুণ দামে তাঁদের কিনতে হয় নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস। গলি, তস্য গলির মধ্যে দিনের পর দিন কাটিয়ে যেতে হয় একচিলতে স্যাঁতস্যাঁতে একটা ঘরে, খদ্দেরের অপেক্ষায় ঠোঁটে লিপস্টিক ঘষে চড়া মেকআপ করতে হয় দিনের বেলাতেও ।অভাবের তাড়না; আর   প্রয়োজন, কারণ খদ্দের ‘লক্ষ্মী’। তাঁদের মনতো যোগাতে হবেই । শোনা যায় সোনাগাছিতে গেলেই নাকি প্রশ্ন করা হয় ‘খাটে না চটে?’ খদ্দের ‘খাট’ চান নাকি ‘চট’ সেই বুঝে তারপর শুরু হয় দরদাম-২০০ থেকে ১০০০-ফুর্তি যত বাড়ে, রেটও বাড়তে থাকে ধাপে ধাপে।

তবে আশার কথা, এন জি ও সন্সথাগুলি বা বিভিন্ন প্রকল্প ছাড়াও বর্তমানে সরকার থেকেও কিছু উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে । আজকাল যৌনকর্মীদের সন্তানদের অনেককেই সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। সরকার থেকে বিভিন্ন ব্যবস্থা করে তাদের অনেককে লেখাপড়াও শেখানো হচ্ছে। যৌন কর্মীদের ছেলেমেয়েরা সেখান থেকে ধীরে ধীরে বের হয়ে সমাজের মূল স্রোতের সাথে মিশে যাওয়ার চেষ্টা করছে ।

Kajal Paul is one of the Co-Founder and writer at BongDunia. He has previously worked with some publishers and also with some organizations. He has completed Graduation on Political Science from Calcutta University and also has experience in News Media Industry.

Leave A Reply