Howrah Bridge History in Bengali – ঐতিহ্যশালী হাওড়া ব্রিজের ইতিহাস
তখন ১৮৫৫ সাল । সেই সময় হুগলি নদীর দু’পাড়ে জাঁকিয়ে বসেছে ইংরেজদের ব্যবসা-বাণিজ্যের কারবার । নদীর দু’পাশে নতুন নতুন কলকারখানা গড়ে উঠেছে ধীরে ধীরে । বর্ধনশীল ব্যবসার খাতিরে হুগলী নদীর দুইপারের দুই যমজ শহর কলকাতা ও হাওড়ার যোগাযোগ স্থাপনের জন্য একটা সেতু নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় । আলোচনা করে ঠিক হয় সেতু নির্মাণের সবরকম দায়িত্ব সরাসরি সরকারের হাতে থাকবে না । সরাসরি সরকারের হাতে পুরোপুরি দায়িত্ব না থাকার কারণে তৈরি করা হয় একটি ট্রাস্ট । এই ট্রাস্টের অধীনে ১৮৭০ সালে বিখ্যাত ইঞ্জিনিয়ার স্যার ব্রাড ফোরড লেসলির নকশায় ১৫২৮ ফুট লম্বা এবং ৬২ ফুট চওড়া পলটুন প্লেস ব্রিজ তৈরির কাজ শুরু হয় । ১৮৭৪ সালে এই পলটুন ব্রিজ তৈরির কাজ শেষ হয় । কিন্তু সেই বছরই ভয়াবহ ঝড় এসে ব্রিজটির বেশ কিছু জায়গায় অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয় । এছাড়া এই ভাসমান সেতুটির সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়, জাহাজ ও স্টিমার যাতায়াতের ব্যবস্থা । কারণ জাহাজ ও স্টিমার গেলে ব্রিজটির মাঝখান দিয়ে খুলে দেওয়া হতো । দীর্ঘ সময় ব্রিজটি বন্ধ থাকার ফলে সৃষ্টি হতে লাগলো প্রচন্ড যানজট । ফলে, পুনরায় নতুন সেতু নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে ব্রিটিশ সরকার । সেই নতুন সেতু, মানে হাওড়া ব্রিজ বা রবীন্দ্র সেতু নির্মাণের পেছনের গল্প কেমন ছিল ?
নানা টানা পোড়নের পর পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯০৬ সালে ইংরেজ সরকার তথা ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে-এর ইঞ্জিনিয়ার আর এস হাইড, ইঞ্জিনিয়ার জর্জ কট, এবং কলকাতা কর্পোরেশনের চিফ ইঞ্জিনিয়ার ডব্লিউ বি ম্যাকেভ- এর নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠিত হয় । তখনকার অবস্থা, সুবিধা, প্রয়োজনীয়তা সব কিছু বিশ্লেষণ করে প্রথমেই নব গঠিত কমিটি নদীর উপর ভাসমান সেতু বা ব্রিজ নির্মাণের বদলে একটি ক্যান্টিলিভার ব্রিজ তৈরির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে । বলা যেতে পারে, রবীন্দ্র সেতু বা হাওড়া ব্রিজ তৈরির মূল সুচনা এখান থেকেই শুরু হয় ।
যদিও শুরুতে বাধা-বিপত্তি কম ছিলনা । সে সময় গোটা বিশ্বে ক্যান্টিলিভার ব্রিজের সংখ্যা ছিল মাত্র তিনটি । যার মধ্যে ক্যান্টিলিভার প্রযুক্তিতে তৈরি কানাডার সেতু ভেঙে পড়ার ঘটনায় লেসলি সাহেব সহ অনেক ইঞ্জিনিয়ারদের ক্যান্টিলিভার সেতু তৈরিতে মত ছিল না । তাছাড়া তখনকার দিনে সড়ক ব্যবস্থার চেয়ে বন্দরের গুরুত্ব ছিল অনেক বেশী । ফলে বন্দরের কাছে গাড়ি চলাচলের থেকে জাহাজ চলাচল ছিল বেশি গুরুত্বপূর্ণ । তাই ক্যান্টিলিভার সেতু থেকে ভাসমান সেতু তৈরি করার পাল্লা বেশী ভারি ছিল । ফলে হাওড়া ব্রিজ তৈরির প্রস্তাব প্রথম দিকে থমকে যায় ।
howrah bridge history in bengali – ঐতিহ্যশালী হাওড়া ব্রিজের ইতিহাস
ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে যায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ । প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কবলে পড়ে এ দেশে আমদানি কম হতে থাকায় দেশের অর্থনীতির ওপর চাপ আসে । ফলে নতুন করে কোন কাজের জন্য ব্রিটিশ প্রশাসন অর্থ বিনিয়োগ করতে নিমরাজি হয়েছিল । প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বেশ কয়েক বছর পর আবার হাওড়া ব্রিজ তৈরির জন্য কথা উঠতে থাকে । ব্রিটিশ প্রশাসন তখন মারতিন এন্ড কোম্পানির মালিক রাজেন্দ্র নাথ মুখার্জী কে সঙ্গে নিয়ে নতুন কমিটি গঠন করে । কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন কলকাতা বন্দরের চেয়ারম্যান ক্লিমেন হিন্দলে, জে ম্যাগ্লাসন এবং ইঞ্জিনিয়ার বেসিল মট । ইঞ্জিনিয়ার বেসিল মট প্রথম সিঙ্গেল ফ্রিজ তৈরীর প্রস্তাব করেন ।
১৯০৫ সালে আর এন মুখার্জী কমিটি চূড়ান্ত রিপোর্ট পেশ করে । যাতে মূলত ক্যান্টিলিভার সেতু তৈরির সুপারিশ করা হয় । ঠিক হয়, এমন প্রযুক্তি ব্যবহৃত হবে, যাতে সেতুর নিচ দিয়ে অনায়াসে জাহাজ ও স্টিমার যাবে করতে পারবে । ১৯২৬ সালে নিউ হাওড়া ব্রিজের নকশা পাশ হয় । ১৯৩০ সালের ১৫ ই মার্চ ব্রিটিশ সরকার হাওড়া ব্রিজ তৈরি হওয়ার নির্দেশ দেন । সেই মতো ১৯৩৪ সালে, ৭০৫ মিটার দীর্ঘ হাওড়া ব্রিজ তৈরির কাজ শুরু হয় । সেই সময় বিশ্বের দ্বিতীয় দীর্ঘতম ক্যান্টিলিভার সেতু তৈরি করেছিলেন রেন্দল পামার ও ট্রেটন । রেন্দল পামার ও ট্রেটনইস্ট ইন্ডিয়া রেল কম্পানির তত্ত্বাবধানে প্রায় ২৫ মিলিয়ন অর্থ বিনিয়োগে এই সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু করেন । সেতুটি তৈরিতে ২৬৫০০ টন ষ্টীল ব্যবহার করা হয়েছিল । যার মধ্যে ২৩০০০ টন ষ্টীল সরবরাহ করে টাটা ষ্টীল । কোন নাট বল্টু ছাড়া কেবলমাত্র ওয়েল্ডিং-এর মাধ্যমে তৈরি হাওড়া ব্রিজের উপর দিয়ে বর্তমানে প্রায় ৩ লক্ষ গাড়ি ও প্রায় সাড়ে চার লক্ষ পথ যাত্রী যাতায়াত করে ।
১৯৬৫ সালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামে হাওড়া ব্রিজ এর নতুন নামকরণ হয় রবীন্দ্র সেতু । ‘গেট ওয়ে টু কলকাতা’ হিসেবে পরিচিত হাওড়া ব্রিজ ১৯৪৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয় । যার প্রথম যান ছিল কলকাতার ঐতিহ্যবাহী ট্রাম । দেশে-বিদেশে হাওড়া ব্রিজের খ্যাতি এমন যে, কলকাতায় আসলে এই হাওড়া ব্রিজ দর্শন না করে কেউ ফিরতে চায় না । বর্তমানে কলকাতা পোর্ট ট্রাস্টের তত্ত্বাবধানে থাকা রবীন্দ্র সেতু এভাবেই যুগযুগ ধরে অসংখ্য মানুষের যাত্রার সাক্ষী হয়ে আছে ।