গ্রাম বাংলার অন্যতম লৌকিক বিশ্বাস ওঝাবিদ্যা। প্রায় গ্রামেই ওঝাদের দেখা মেলে। যারা বিভিন্ন ধরনের মন্ত্র ঝাড় ফুক করে রোগ ভাল করে দেন বলে অনেকে মনে করেন। দেখা গেছে, সাপের ছোবল খাওয়া ব্যক্তিরা আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে গেছেন। দেশ-বিদেশ থেকে কবিরাজি জ্ঞানে পারদর্শিতার সনদও রয়েছে তাঁর। কিন্তু নিজে যখন সাপের ছোবল খেলেন, তখন আর কোনো মন্ত্রেই কাজ হলো না। সুন্দরবন অঞ্চলে এরকম লোকিক বিদ্যা বা ওঝাবিদ্যার দেখা মেলে। সুন্দরবন অঞ্চলে বণ্যপ্রাণীর আক্রমণ, প্রাকৃতিক দূর্যোগ, বাঘের আক্রমন, সাপের আক্রমনে প্রতিনিয়ত অসংখ্য লোক মারা যায়। এসকল মৃত্যু বা বিপদ থেকে রক্ষা পেতে মানুষ অলোকিক শক্তির দ্বারস্থ হয়।

হিংস্র বাঘের আক্রমন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য রয়েছে বিভিন্ন মন্ত্র। “হুম লোহ অ কেছা লোহু; হাত্তা এজা বালাগা; আশাদ্দাহু বালাগা; আর রাইনা ছানাতা” এরকম অসংখ্য মন্ত্র ছড়ানো রয়েছে সুন্দরবনের পরতে পরতে। কথিত আছে চালান মন্ত্র পড়ে চালান দিলে সেখানকার বাঘ ৪১ দিন কিছু খেতে পারে না। তবে ৪১ দিন পর সে সামনে যাকে পাবে তাকেই খাবে।

সাপে কামড়ালে ওঝা ডোর বা পাট সুতার সাহায্যে বিষ নামায়। পাট দিয়ে বেঁধে হাত দিয়ে আস্তে আস্তে নীচের দিকে টানতে থাকে। সুতা সাপের প্রতিক হিসাবে ব্যবহৃত হয় “ ডোর ডোর পাটের ডোর; সিদ্ধির মাথায় পেয়েছে চোর; বিষ তুই পাট ছাড়া উর্দ্ধে যাস; মা পদ্মাদেবীর মাথা খাস।“

এছাড়া বিভিন্ন রোগে নিমের পাতা দিয়ে ওঝা বিভিন্ন মন্ত্র দিয়ে ঝাড় ফুঁক করে থাকে। নিমের পাতা রোগ নিরামক হিসাবে খ্যাত। কানে ব্যাথা, কোন কিছু হারিয়ে গেলে, কোন কিছু ভেঙ্গে গেলে, বিয়ের জন্য সহ বিভিন্ন বিষয়ের সাথে ওঝা বিদ্যা জড়িত রয়েছে।

ওঝারা অনেক সময় হারিয়ে যাওয়া জিনিস খুজে পাওয়ার জন্য হাত চালান, চাল পড়া সহ বিভিন্ন ঝাড় ফুক করে থাকে। হাত চালান দিতে তুলা রাশির ব্যাক্তির হাতকে ব্যবহার করা হয়। এছাড়া আয়না পড়াও দেখা যায়। আয়না পড়ায় “ আয়না আয়না ব্রহ্ম আয়না; তুলা রাশির দিকে ফিরে বয়না; যদি না কস কথা, খাস তোর; রাম লক্ষণের মাথা; কার আজ্ঞে; কামরূপ কামাক্ষ্যা কালীর আজ্ঞে; দোহাই মা কালী (৩ বার); গুরু গোবোদ মরে আছে যেখানে; আমার ধর্মের আয়না দেখায় সেখানে; মাল চোর আসে যেখানে; দোহাই এস্তাক মুণি”

গ্রাম অঞ্চলের স্থায়ী ওঝা ব্যাতিত সুন্দরবন অঞ্চলে বিভিন্ন ঋতুতে বেঁধে-দের দেখা যায়। যারা অস্থায়ীভাবে বসবাস করে। তারা সাপ ধরে, খেলা দেখিয়ে প্রধানত জীবিকা অর্জন করে। এছাড়া বাতের ব্যাথা সহ বিভিন্ন রোগীদের চিকিৎসা করে থাকে। ওঝারা সাধারণত: অর্থের পাশাপাশি বিভিন্ন উপহার সামগ্রী নিয়ে থাকে। এজন্য রোগ ও ওঝাদের চাহিদা ভিত্তিতে সওয়া সের চাল, তেল সহ বিভিন্ন সামগ্রী দেওয়ার রীতি রয়েছে।

ধর্মীয় দিক থেকে ওঝারা হিন্দু মুসলিম উভয় ধর্মের হয়ে থাকে। সংখ্যার বিচারে মুসলমান ওঝার সংখ্যা বেশি। দীনেশচন্দ্র সেনের মতে “বাংলাদেশের সাপ ও ভূতের ওঝাদের মধ্যে অধিকাংশই ধর্মান্তরিত মুসলমান”। হিন্দু ও বৌদ্ধ গুণিনরা ধর্মান্তর করলেও তারা তাদের পেশা ও সংস্কার ত্যাগ করতে পারে না।

সুন্দরবন অঞ্চলের মানুষের বদ্ধমূল ধারণা রয়েছে জ্বীন-পরী, ভূত-প্রেত নিজন নিঝুম রাতে বিশেষ করে পোড়োবাড়িতে বা শ্মশান ভূমিতে বসবাস করে। এছাড়া ভূত-প্রেত বাঁশ বনে, ষাড়া গাছে অনেক সময় তাল গাছে অবস্থান করে। গাছের ক্ষেত্রে তিন পাঁচ সংখ্যার দেখা পাওয়া যায়। তিনটি তাল গাছ এক জায়গায় থাকলে সেখানে ভূত থাকে বলে কথি আছে।

দুর্বল চিত্ত অথবা মহিলারা মাতৃত্ব সময়ে বিভিন্ন মানসিক বিকারগ্রস্থ হন। এসব অঞ্চলের লোকেরা এসব মানসিক সমস্যাকে ভূতে পাওয়া, পেত্নিতে পাওয়া বলে মনে করেন। অনেক সময় ছোট বাচ্চারা ভয় পেতে থাকে। এই ভয় পাওয়া থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য গুণিন ওঝারা বাড়ি বন্ধক করে। ভয় বন্ধ করার জন্য ওঝার মন্ত্র “ধনুকে হইল গণ্ডী করিল লক্ষণ; শর যোজনা করেন স্বয়ং রাম নারায়ণ; ভূত তাড়ানোর জন্য গুণিনদের মন্ত্র “ শক্তি শক্তি জগতের সার; শক্তির স্মরণে মরণ নাই আমার”

এসমব মন্ত্র গুণীনরা বংশ পরম্পরায় এসব মন্ত্রকে অতি মূল্যবান সম্পদ হিসাবে আগলে রাখেন। ওঝারা বংশ পরম্পরায় এ শিক্ষা লাভ করে থাকেন। এ বিদ্যা লাভ করতে শিষ্যত্ব অর্জন করতে হয়। শিষ্যের অগাধ গুরুভক্তি, শ্রদ্ধা, জ্ঞান, বিদ্যা থাকতে হয়। গুরুরা তাদের বিদ্যা বাইরে প্রকাশ করতে চান না। তবে সুন্দরবন অঞ্চলের লোকেরা মনে করে এই ওঝাদের মন্ত্রের শক্তি অপরিসীম।

Mr. Shuva is a News and Content Writer at BongDunia. He has worked with various news agencies all over the world and currently, he is having an important role in our content writing team.

Leave A Reply