ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ইতিহাস
[Essay On Freedom Fighters Of India]
ভারতবর্ষের বিপুল ধন-ঐশ্বর্যের কারণে প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন ঔপনিবেশিক শক্তি ভারতবর্ষে তাদের বাণিজ্যিক ঘাঁটি স্থাপন করেছে। তবে ধীরে ধীরে এই ঔপনিবেশিক শক্তিগুলি ভারতের রাজনীতিতে অংশগ্রহন করতে শুরু করলে ভারতের শাসন কাঠামোর ওপর এর প্রভাব পড়তে শুরু করে। পর্তুগিজ, ওলন্দাজ, দিনেমার, ফরাসী, ব্রিটিশ প্রভৃতি বিভিন্ন ঔপনিবেশিক শক্তি’গুলি একের পর এক ভারতের মাটিতে পদার্পণ করলেও মূলত ফরাসী এবং ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সক্রিয়ভাবে ভারতের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করে। উল্লেখ্য, ভারতে প্রথম ঔপনিবেশিক শাসন কাঠামো স্থাপন করার স্বপ্ন দেখেছিলেন ফরাসী গভর্নর যোসেফ ফ্রান্সিস ডুপ্লে, তবে তাঁর স্বপ্নকে সম্পূর্ণরূপে বিনষ্ট করে দিয়ে ভারতে তাঁদের স্থায়িত্ব নিশ্চিত করেছিলেন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অন্যতম মুখপাত্র রবার্ট ক্লাইভ। Indian Freedom Fighters (Essay On Freedom Fighters Of India)
মূলত ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার নবাব সিরাজ-উদ্-দৌলা’কে পরাজিত করার মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শক্তির আধিপত্য শুরু হলেও ১৭৬৪ খ্রিষ্টাব্দে বক্সারের যুদ্ধে বাংলার নবাব মীরকাশিম, অযোধ্যার নবাব সুজা-উদ্-দৌলা এবং মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের মিলিত জোট’কে পরাজিত করার পরই ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতবর্ষে স্থায়ীভাবে শাসন ও সাম্রাজ্যবিস্তার করতে শুরু করে।
প্রায় দু’শো বছর যাবৎ ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’র নির্মম অত্যাচার, শাসন ও শোষণ ব্যবস্থার পর অবশেষে ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই আগস্ট ভারত-পাকিস্তান বিভাজনের মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষ সম্পূর্ণরূপে স্বাধীনতা অর্জন করে। তবে ভারত স্বাধীন হওয়ার এই দীর্ঘ পথ একেবারেই সহজ ছিলনা, এর পেছনে রয়েছে শত শত বীর ভারতসন্তানের অকৃপণ রক্তের বলিদান।
আঞ্চলিক শক্তিগুলির সাথে কোম্পানির সংঘর্ষঃ
ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতবর্ষে স্থায়ীভাবে শাসন ও সাম্রাজ্যবিস্তার করতে শুরু করার পর একে একে ভারতীয় আঞ্চলিক শক্তিগুলি পৃথক পৃথক সময়ে ব্রিটিশ শক্তির সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হলেও তাঁদের মধ্যে কখনও একতা লক্ষ্য করা যায়নি। এক্ষেত্রে ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ, ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধ কিংবা ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধের কথা উল্লেখ করা যায়। এর ফলস্বরূপ, বহু প্রচেষ্টা স্বত্বেও আঞ্চলিক শক্তিগুলি ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া শক্তিকে পরাজিত করতে পারেনি।
মহাবিদ্রোহঃ
ঔপনিবেশিক শক্তির নির্লজ্জ শাসন ও শোষণ নীতির ফলস্বরূপ ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দে ভারতবর্ষে এক মহাযুদ্ধের পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। মূলত এটি একটি সিপাহী বিদ্রোহ হলেও বিদ্রোহের আকার, ভারতবর্ষের বিভিন্ন আঞ্চলিক শক্তির যোগদান এবং বিশালতার কারণে এটি ‘মহাবিদ্রোহ’ রূপে পরিচিত হয়।
বিদ্রোহের কারনঃ ১৭৬৪ খ্রিষ্টাব্দে বক্সারের যুদ্ধে চূড়ান্ত জয়লাভ এবং তার পরপর আঞ্চলিক শক্তিগুলির অবসান ঘটানোর মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এক নির্লজ্জ রূপ ধারণ করেছিলো। নানা অজুহাতে কোম্পানি ভারতের বিভিন্ন আঞ্চলিক শক্তিগুলির শাসকের ক্ষমতা কেড়ে নিতে থাকায় আঞ্চলিক শক্তিগুলি ঔপনিবেশিক শক্তির ওপর প্রচণ্ড পরিমাণে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলো।
অপরদিকে এই সময় ইংরেজরা ভারতে এনফিল্ড রাইফেল-এর প্রচলন শুরু করে। উল্লেখ্য, এনফিল্ড রাইফেল এর কার্তুজ দাঁতে কেটে বন্দুকে পুরতে হত। শোনা যায় যে এই কার্তুজ তৈরি হত গরু এবং শূকরের চর্বি মিশিয়ে, ফলে ধর্মানুরাগী ভারতীয় সিপাহীদের কেউই এই বন্দুক ব্যবহারে সম্মত হননি। তা স্বত্বেও কোম্পানির সেনাপ্রধানেরা ভারতীয় সেনাদেরকে এই কার্তুজ ব্যবহারে বাধ্য করতো। অবশেষে ১৮৫৭ সালের ২৯ মার্চ ব্যারাকপুর সেনা ছাউনি’র ৩৪ নং. রেজিমেন্টের সেনা মঙ্গল পাণ্ডে’কে কার্তুজ দাঁতে কাটতে বাধ্য করা হলে তিনি ইংরেজ অফিসার অ্যাডজুট্যান্ট লেফটেন্যান্ট বাগ এবং সার্জেন্ট মেজরকে প্রকাশ্যে হত্যা করে প্রথম মহাবিদ্রোহের সূচনা করেন।
বিচারে মঙ্গল পাণ্ডে এবং আরেক ভারতীয় সেনা ঈশ্বরী প্রসাদ পাণ্ডের ফাঁসি হয়। তবে ইতিমধ্যেই বিদ্রোহের আগুন ছড়াতে শুরু করেছে। একে একে বিদ্রোহে যোগদান করেন ঝাঁসির রাণী লক্ষ্মীবাই, নানাসাহেব, তাতিয়া টোপী, মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ প্রমুখ। Indian Freedom Fighters (Essay On Freedom Fighters Of India)
পরাজয়ের কারনঃ ভারতবর্ষের বহু আঞ্চলিক শক্তি এবং সেনাবাহিনীর যোগদানের ফলে মহাবিদ্রোহ একটি ভয়াবহ রূপ নিলেও ভারতের সকল অংশ থেকে মহাবিদ্রোহে সমান সমর্থন পাওয়া যায়নি। এদেশে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সৈন্য কম ছিল ঠিকই, তবে অপরদিকে ভারতের গোর্খা, শিখ, গুর্জর প্রভৃতি শক্তিশালী জাতিগুলি মহাবিদ্রোহ প্রতিরোধে ইংরেজদের সহায়তা করেছিলো।
উল্লেখ্য, বেঙ্গল প্রেসিডেন্সী’র ব্যারাকপুর সেনাছাউনি থেকে প্রথম বিদ্রোহের সূচনা হলেও বাঙালী সেনারা সেভাবে বিদ্রোহে যোগদানের ইচ্ছাপ্রকাশ করেননি।
এছাড়াও মহাবিদ্রোহের সময় ভারতবর্ষের শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়গণ বিদ্রোহ থেকে সম্পূর্ণরূপে নিজেদেরকে আলাদা রেখেছিল।
আধুনিক স্বাধীনতা সংগ্রামঃ
ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নির্মম শাসন ও শোষণ নীতির কারণে ক্রমে সমগ্র ভারতবর্ষে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিলো। এমতাবস্থায় একসময় ভারতের শিক্ষিত এবং সমাজমনস্ক মানুষেরাও ব্রিটিশ শাসকদলের এহেন জঘন্য আচরণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠেন। তার ফলস্বরূপ ১৮৩৭ খ্রিষ্টাব্দের ‘জমিদার সমিতি’-র কথা উল্লেখ করা যায়।
আর এর চূড়ান্ত পরিণতি হিসাবে ভারতে জাতীয় কংগ্রেস দলের প্রতিষ্ঠা হয়। মূলত ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে আয়োজিত সর্বভারতীয় সম্মেলনকে ভারতে জাতীয় কংগ্রেসের সূচনাপর্ব বলে উল্লেখ করা হয়। এপ্রসঙ্গে ডঃ অমলেশ ত্রিপাঠির বলেছেন, “কংগ্রেসের প্রায় দু’বছর আগে তাঁর জাতীয় কনফারেন্সের প্রথম অধিবেশন (কলকাতা)-কে জাতীয় কংগ্রেসের মহড়া বলা চলে।”
তবে এই সময় ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ক্রমাগত ব্রিটিশ শাসকদের সঙ্গে আপোষের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনের চেষ্টা করতে থাকেন, যা ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসে ‘রাজনৈতিক ভিক্ষাবৃত্তি’ আখ্যা পায়।
এরই ফলস্বরূপ ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে কংগ্রেসের সুরাট অধিবেশনে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস দু’টি পৃথক দলে বিভাজিত হয়ে যায়, যথা – চরমপন্থী ও নরমপন্থী। কংগ্রেসের নরমপন্থী নেতারা হলেন উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, ফিরোজ শাহ মেহতা, বদরুদ্দিন তায়েবজি, দাদাভাই নৌরজি, শঙ্করণ নায়ার, গোপালকৃষ্ণ গোখলে, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, আনন্দ চার্লু প্রমুখ এবং চরমপন্থী নেতাদের মধ্যে ছিলেন লালা লাজপত রায়, বাল গঙ্গাধর তিলক ও বিপিনচন্দ্র পাল (লাল-বাল-পাল), অশ্বিনীকুমার দত্ত প্রমুখ।
জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর একে একে বহু বীর ভারতীয় যুবক এই মহা আন্দোলনে সামিল হতে শুরু। যাদের সকলের রক্তে একদিন ভারতমাতা ঔপনিবেশিক শক্তির হাত থেকে সম্পূর্ণরূপে স্বাধীন হয়ে ওঠে। এমনই কিছু বীর স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নাম নীচে উল্লেখ করা হল,
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের তালিকা (Indian Freedom Fighters):
- কমল নাথ তিওয়ারি
- শিবরাম রাজগুরু
- অরবিন্দ ঘোষ
- চন্দ্রশেখর আজাদ
- অ্যানি বেসান্ত
- সরোজিনী নাইডু
- রামপ্রসাদ বিসমিল
- ক্ষুদিরাম বসু
- শুকদেব
- নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু
- যতীন্দ্রনাথ দাস
- বটুকেশ্বর দত্ত
- মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী
- হেমু কালানি
- বীরাপান্ডিয়া কাট্টাবোমান
- আসফাকউল্লা খান
- বিনয় বসু
- বাদল গুপ্ত
- দীনেশ গুপ্ত
- বাঘাযতীন
- সৈয়দ আহমদ খান
- মদন মোহন মাল্যব্য
- জওহরলাল নেহ্রু
- ভি. ও. চিদাম্বরম পিল্লাই
- অরুণা আসফ আলি
- আল্লুরি সিতারামারাজু
- দয়ানন্দ সরস্বতী
- ভগৎ সিং
- সর্দার অজিত সিং
- উধম সিং
- বিনায়ক দামোদর সাভারকর
- বাল গঙ্গাধর তিলক
- বাহাদুর শাহ জাফর
- চুনিলাল ভাইদয়া
- মাস্টারদা সূর্য সেন
- প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার
- মহাদেব গোবিন্দ রানাডে
প্রমুখ এবং আরও বহু বীর ভারতসন্তান’দের রক্তের পরিবর্তে আজ আমরা স্বাধীন ভারতমাতাকে ফিরে পেয়েছি।