বং দুনিয়া ওয়েব ডেস্কঃ চলতি বছর চীনের কাছে একটা কঠিন সময় । একদিকে করোনা নিয়ে অভিযোগের তীর তাদের দিকে, অন্য দিকে ভারতের সাথে সংঘর্ষের জেরে বিপুল পরিমাণে আর্থিক ক্ষতির স্বীকার । পাশাপাশি সুযোগ বুঝে দক্ষিন চীন সাগরের চীনা আধিপত্যের উপর অন্যান্য দেশের সমর্থন নিয়ে আমেরিকার প্রচণ্ড চাপের সামনা করা । কিন্তু কেন দক্ষিন চীন সাগর চীনের কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ  ! আমেরিকার মাথা ব্যাথাও বা কোথায় ! এই প্রশ্নগুলি উঠে আসাটাই স্বাভাবিক ।

চীন এই মুহূর্তে ঠিক কি রকম চাপের মুখে রয়েছে জানতে হলে কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে । ভারতের সাথে সীমান্ত বিবাদে জড়িয়ে চীন যেভাবে একের পর এক আর্থিক এবং রাজনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়ছে তা সকলেরই জানা । এর সাথে রয়েছে,   করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়ানো নিয়ে অভিযোগ, আমেরিকার সাথে বাণিজ্য যুদ্ধ, হংকং-য়ে জাতীয় নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন নিয়ে জাপানের সাথে বিরোধ, ভারতের পক্ষে ইসরায়েলের সমর্থন এবং নানা অর্থনৈতিক টালমাটাল। এসবের সাথে এবার যুক্ত হয়েছে দক্ষিন চীন সাগর নিয়ে উত্তেজনা । পরিস্থিতি এই মুহূর্তে এমন একটি জায়গায়, যে কোন সময় উত্তেজনা বেড়ে যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে । যদিও সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে চীনের এই নতুন দ্বীপ রাজ্যগুলোকে গুঁড়িয়ে দেবার ক্ষমতা আমেরিকা অবশ্যই রাখে। কিন্তু তার অর্থ হবে চীনের সাথে সরাসরি যুদ্ধ বাধানো, যেটা চীন এবং আমেরিকা দুজনের কারোর জন্যই বাঞ্ছনীয় হবে না।

দক্ষিন চীন সাগর কেন চীনের কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে এক নজরে দেখে নেওয়া যাক –

দক্ষিণ চীন সাগর গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক নৌ চলাচল পথ। তবে বহু বছর ধরে এই সাগরের ছোট ছোট অসংখ্য দ্বীপ, যার অনেকগুলোই প্রবাল দ্বীপ, প্রবালপ্রাচীর এবং দ্বীপগুলোর সম্পদের মালিকানা দাবি করে আসছে ওই অঞ্চলের বেশ কয়েকটি দেশ এবং অনেকদিন ধরেই এই সাগর ওই অঞ্চলে একটা বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে রয়েছে। কিন্তু চীন প্রভাব খাটিয়ে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই এলাকায় তাদের মালিকানার দাবি জোরদার করেছে । চীনের দাবী বিতর্কিত এই এলাকাটি কয়েক শতাব্দী ধরে চীনের অংশ ।

গত কয়েক বছর ধরে চীন এখানে একের পর এক পরিকল্পনা করেছে । খরচ করেছে প্রচুর অর্থ । চীন মনে করে দক্ষিণ চীন সাগর তার সমুদ্র এলাকার গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ। হাইনান দ্বীপে চীনের পারমাণবিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার যে সামুদ্রিক ঘাঁটি রয়েছে শুধু সে কারণেই নয়, চীনের বিশাল বৈশ্বিক উন্নয়ন প্রকল্প, বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের অংশ হিসাবে সিল্ক রোডের সামুদ্রিক পথও এই সাগর এলাকা।

ফলে চীনের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ভবিষ্যত সাফল্যের জন্য এই দক্ষিণ চীন সাগর নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখা চীনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ২০১২ সাল থেকে দক্ষিণ চীন সাগরের দ্বীপগুলোতে উন্নয়ন ও বসতি তৈরি এবং  দ্বীপগুলোর প্রশাসনিক কাঠামো চীন উন্নত করেছে।প্রাথমিক স্কুল, ব্যাংক, হাসপাতাল এবং মোবাইল যোগাযোগের ব্যবস্থা বসিয়েছে। মূল ভূখণ্ড থেকে পর্যটকরা নিয়মিত প্রমোদতরীতে দ্বীপগুলো ভ্রমণে যায়।

উপগ্রহ চিত্র থেকে দেখা যাচ্ছে দ্বীপগুলিতে চীনের উন্নয়নমূলক কাজ

দ্বীপগুলিতে উন্নয়নের দ্বিতীয় ধাপে স্প্র্যাটলি দ্বীপপুঞ্জ অধিগ্রহণের কাজও চীন এগিয়ে রেখেছে । প্রশাসনিক সুযোগ সুবিধা দেয়া হয়েছে। স্প্র্যাটলির ছোট ছোট প্রবালদ্বীপে গত ছয় বছরে চীন নৌ প্রকৌশল ও সামরিক স্থাপনা গড়ে তুলেছে, যার মধ্যে রয়েছে বিমান অবতরণ ক্ষেত্র, নৌবাহিনীর রসদের মজুদ ও বিমান ঘাঁটি, গোলবারুদের বাঙ্কার, রেডার ক্ষেত্র এবং ভূগর্ভস্থ ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপক সরঞ্জাম। কোন কোন প্রবাল দ্বীপে গড়ে উঠেছে ফল, সব্জি ও পশু খামার।এমনকী একটি প্রবাল দ্বীপের সামুদ্রিক গবেষণা কেন্দ্রে চীনা বিজ্ঞান অ্যাকাডেমিও স্থাপন করা হয়েছে ২০১৯এর জানুয়ারি মাসে।

এসব প্রবাল দ্বীপের বাসিন্দারা ফাইভ-জি মোবাইল ডেটার সুবিধা ভোগ করেন।জেলেদের হাতে এখন পৌঁছে গেছে উন্নত মাছ ধরার নৌকা, তাদের জীবন যাপন সেখানে অনেক স্বচ্ছল হয়েছে।উপগ্রহ ও বিমান পর্যবেক্ষণ ক্যামেরায় এসব স্থাপনার ছবি, সেইসাথে হাসপাতাল, খেলাধুলার কেন্দ্র ও বিভিন্নধরনের ভবনের ছবি ধরা পড়েছে।

দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য সংঘাতের মধ্যেও ওই এলাকার মালিকানা নিয়ে আঞ্চলিক বিবাদে কোন পক্ষ নেয়নি আমেরিকা। তারা শুধু ওই অঞ্চলে তাদের জাহাজ চলাচলের স্বাধীনতা দাবি করে এসেছে। কিন্তু এখন চীনকে চাপে ফেলার ভাল সুযোগ আমেরিকার হাতে এসেছে । এপ্রিলের গোড়ায় চীনা উপকূলরক্ষীদের একটি জাহাজ প্যারাসেল দ্বীপপুঞ্জের কাছে ভিয়েতনামের একটি জেলে নৌকা ডুবিয়ে দেয়। চীন এবং ভিয়েতনাম দুটি দেশই এই দ্বীপপুঞ্জের মালিকানা দাবি করে থাকে। এর পরপরই বোর্নিও উপকূলের কাছে মালয়েশিয়ার একটি তেল উত্তোলন প্রকল্পের কাজে বাধা দেয় চীনা নৌ বাহিনী ও উপকূল রক্ষীবাহিনীর অধীনস্থ একটি চীনা পর্যবেক্ষণ জাহাজ।

এর পরই আমেরিকান নৌবাহিনীর একটি রণতরী এবং অস্ট্রেলিয়ার একটি যুদ্ধজাহাজ কাছাকাছি সাগরে মোতায়েন করা হয়।ভারতের সাথে সীমান্ত বিবাদ থাকায়, সেখানে ভারতের নৌবাহিনী মহড়া শুরু করেছে । পাশে আছে হংকং নিয়ে বিরোধের জের হিসাবে জাপান । অথচ মাত্র কিছুদিন আগেই চীন, দক্ষিণ চীন সাগরের একটা অংশ বন্ধ করে দেয় প্যারাসেল দ্বীপের চারপাশের সমুদ্রে নৌবাহিনীর মহড়া চালানোর জন্য। কিন্তু এখন পরিস্থিতি আমুল বদলে গেছে । আমেরিকা প্যারাসেল দ্বীপপুঞ্জ এবং স্প্র্যাটলি দ্বীপপুঞ্জে তাদের নৌবাহিনীর আরও দুটি ক্ষেপণাস্ত্র বিধ্বংসী জাহাজ পাঠিয়েছে ।

দক্ষিন চীন সাগর নিয়ে আমেরিকার মাথা ব্যাথার পিছনে আরও কারন আছে । একদিকে দক্ষিন চীন সাগরে গত কয়েক বছর ধরে  চীনের ব্যাপক বিনিয়োগ থেকে এটা স্পষ্ট যে কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার এই সমুদ্র এলাকায় চীন তার মালিকানা প্রতিষ্ঠার জন্য গত কয়েক বছর ধরে পরিকল্পিতভাবে এগিয়েছে। সেখান থেকে ফেরা চীনের জন্য এখন একরকম অসম্ভব। চীনের এই অধিকার খর্ব করার জন্য  ওই এলাকার ওপর চীনের দাবি “সম্পূর্ণ অবৈধ” বলে আনুষ্ঠানিকভাবে আমেরিকা ঘোষণা করেছে ।  এই কারনে শুধু ওই দ্বীপগুলোর মালিকানার দাবিদার দেশগুলোর সাথে হাত মেলানো নয়, আমেরিকা চাইছে, তাদের পাশাপাশি আরও বড় শক্তির দেশগুলোকে সাথে নিয়ে চীনের বিরুদ্ধে একটা কূটনৈতিক জোট গড়তে? কারন চীনের অধিকার খর্ব করতে এটাই সঠিক সময় বলেই ধরা হচ্ছে ।

Kajal Paul is one of the Co-Founder and writer at BongDunia. He has previously worked with some publishers and also with some organizations. He has completed Graduation on Political Science from Calcutta University and also has experience in News Media Industry.

Leave A Reply