রাখীবন্ধন উৎসবের দিন দিদি বা বোনেরা তাদের ভাইয়ের হাতে রাখী নামে একটি সুতো বেধে দেয়। বোনেকে রক্ষা করা শপথ নেয় ভাইয়েরা। অনেকে মনে করে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ এ উৎসবের প্রচলন করেন। রাখীবন্ধন বলতে আমরা বুঝি সুরক্ষা বন্ধন। এই সুরক্ষা বন্ধনের আছে ইতিহাস ও ঐতিহ্য। রাখি পূর্নিমায় বোনেরা ভাইয়েদের হাতে রাখি বেধে দেয়। শরত মাসে (আগস্ট) মাসে পূর্ণবর্ষের দিনটি পালন করে রাখি বন্ধন বা রক্ষী উৎসব। সমগ্র হিন্দুরা সারা পৃথিবী জুড়ে রাখীবন্ধন উদযাপন করতে অবতরণ করে, প্রধানত ভারতে, নেপাল ও পাকিস্তানের কিছু অঞ্চলে।

ভারতীয় পুরাণে, একটি পূর্ণিমা দিবসকে একটি শুভদিন বলে মনে করা হয়। কৃষকদের কাছে, এটি “কজি পূর্ণিমা” হিসাবে পালিত হয়। এই দিনে কৃষকেরা গমের বীজ বপন শুরু করে এবং ভাল ফসলের জন্য ঈশ্বরকে প্রার্থনা করে এবং ভারতের শিতল অঞ্চলে এই দিনে “নারায়ণী পূর্ণিমা” হিসাবে পালিত হয়।

কৃষ্ণ ও দ্রোপদী-

মহাভারতে উল্ল্যেখ আছে একটি যুদ্ধের কৃষ্ণ-এর কবজিতে আঘাত লাগে। এই আঘাতে রক্তপাত শুরু হলে পান্ডব স্ত্রী দ্রোপদী শড়ির আচল ছিড়ে কৃষ্ণের হাতে বেধে দেন। কৃষ্ণ অভিভূত হয়ে যান এই অনাত্মীয়ার কাজ দেখে এবং দ্রোপদীকে তিনি নিজের বোন বলে ঘোষণা দেন। দ্রোপদীকে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দেন।

বলিরাজা ও লক্ষ্মী

দৈত্যরাজা বলি ছিলেন বিষ্ণুর ভক্ত। বিষ্ণু বলিরাজার রাজত্ব রক্ষা করার জন্য পৃথিবীতে আসেন। লক্ষ্মী তার স্বামীকে ফিরে পাওয়ার জন্য ছদ্মবেশে বলিরাজার কাছে আশ্রয় নেন। শ্রাবণ পূর্ণিমা উৎসবে লক্ষ্মী বলিরাজার হাতে রাখী বেধে দেন। নিজের স্বামীকে ফিরিয়ে নেওয়ার মনস্কামনা জানালে বলিরাজা বিষ্ণুকে বৈকুন্ঠে যেতে অনুরোধ করেন। বলিরাজা জানতেন বিষ্ণু তার রাজত্ব ছেড়ে গেলে আর তার রাজত্ব থাকবে না।

সন্তোষী মা

রাখীবন্ধনের দিনে গণেশের বোন গণেশ হাতে রাখি বেধে দেন। গণেশের দুই পুত্র তা দেখে ফেলে এবং তাদের কোন বোন নেই বলে  তারা তার বাবার কাছে একটি বনের বায়না ধরে। গণেশ তার দুই পুত্রের সন্তুষ্টি জন্য অগ্নি থেকে একটি কন্যা জন্ম দিয়েছে এই দেবী গণেশের মেয়ে সন্তোষী মা। সন্তোষী মা গনেশের দুই পুত্র শুভ ও লাভের হাতে রাখী বেধে দেন। ১৯৭৫ সালে বলিউডে এ কাহিনী নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মিত হয় ‍‌‍“জয় সন্তোষী মা”

জম ও যমুনার কিংবদন্তি: –
যমুনা তার ভাই জম (মৃত্যুর দেবতা) খুব দুঃখের সাথে হারিয়ে গেলে তিনি ১২ বছর ধরে যমুনা নদীতে যাননি। যমুনাকে গঙ্গা (পবিত্র নদী গঙ্গা) পরামর্শ দিয়েছিলেন এবং দুঃখের কারণ বলেছিলেন। গঙ্গা তখন তার বোন সম্পর্কে জমকে স্মরণ করিয়ে দিলেন। যমুনাও তার ভাই জমকে রাখি বন্ধন করেছিলেন।

মহামতি আলেকজান্ডার ও পুরু রাজা

৩২৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মহামতি আলেকজান্ডার ভারত আক্রমন করলে আলেকজান্ডারের স্ত্রী রোজানা রাজা পুরুকে একটি পবিত্র সুতো পাঠিয়ে দেন এবং তাকে অনুরোধ করেন আলেকজান্ডারের ক্ষতি না করার জন্য। পুরু রাখীকে সম্মান করতেন। তিনি ছিলেন কটোচের রাজা। রাখীকে সম্মান করে যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি আলেকজান্ডারকে নিজে আঘাত করেননি।

রানি কর্ণবতী ও সম্রাট হুমায়ুন

১৫৩৫ খ্রিস্টাব্দে মুঘল সম্রাট হুমায়ুনকে চিতোরের রানি কর্নবতী রাখী পাঠান। গুজরাতের সুলতান বাহাদুর শাহ চিতোর আক্রমন করলে রানী অসহায় বোধ করে হুমায়ুনের সাহায্য প্রার্থনা করেন। হুমায়ুন রাখি পেয়ে চিতোর রক্ষার্থে সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন। হুমায়ুনের সেনা পাঠাতে দেরি হয়ে যাওয়ায় রানী কর্নবতী দূর্গ দখল হয়ে যায়। পরে রানী সম্ভ্রম রক্ষার্থে ৮ মার্চ ১৩০০০ পুরস্ত্রীকে নিয়ে জহর ব্রত পালন করে আগুনে পুড়ে মারা যান।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

১৯০৫ সালের ২০ জুলাই বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করা হয়। শ্রেণি বর্ণ নির্বিশেষে বাংলার সকল মানুষই এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করেন। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে সামিল হন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও। ঈশ্বর বাংলার মানুষকে বিভক্ত করেননি। সেই কথা মাথায় রেখে তারই নিদর্শনস্বরূপ তারা একে অপরের হাতে বেঁধে দেবেন হলুদ সুতো। মুখে বলবেন- ভায়েদের মধ্যে বিভেদ করা যাবে না। দিনটিকে রাখি বন্ধনের দিন হিসেবে পালন করার ডাক দেন বিশ্বকবি। বাংলা তথা বাঙালির ঐক্য, বাঙালির সংস্কৃতি, তাদের আশা আকাঙক্ষা তুলে ধরে গান লিখলেন রবীন্দ্রনাথ।
“বাংলার মাটি বাংলার জল বাংলার বায়ু বাংলার ফল-
পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক হে ভগবান।
বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন বাংলার মাঠ-
পূর্ণ হউক, পূর্ণ হউক, পূর্ণ হউক হে ভগবান।
বাঙালির পণ, বাঙালির আশা, বাঙালির কাজ, বাঙালির ভাষা-
সত্য হউক, সত্য হউক, সত্য হউক হে ভগবান।
বাঙালির প্রাণ, বাঙালির মন, বাঙালির ঘরে যত ভাই বোন-
এক হউক, এক হউক, এক হউক হে ভগবান।”

কলকাতার বিডন স্কোয়ারে ও বাংলার নানান জায়গায় রাখি বন্ধন উৎসবের আয়োজন করা হয়।

রাখীবন্ধন বাঙ্গালীর ইতিহাস ঐতিহ্যের সাথে জড়িত। সমস্ত বিশ্ব যখন হানাহানিতে জর্জরিত তখন আমরা একে অপরের হাতে রাখীবেধে অন্যকে ও নিজেকে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি নিই। এই হোক রাখীবন্ধন উৎসবে আমাদের সকলের কামনা।

Mr. Shuva is a News and Content Writer at BongDunia. He has worked with various news agencies all over the world and currently, he is having an important role in our content writing team.

Leave A Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.