বং দুনিয়া ওয়েব ডেস্কঃ দেশকে মায়ের আসনে, বসিয়ে তার প্রতি সীমাহীন ভালোবাসা আর শ্রদ্ধার কারনেই ব্রিটিশ শাসকের মাটিতে দাঁড়িয়ে বুক ভরা আশা নিয়ে, স্বপ্ন দেখতে পেরেছিলেন যিনি, তিনি আর কেউ নন, আমাদের অতি আদরের, পরম কাছের, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোস । কতটা ভালোবাসা আর আবেগ বুকের মধ্যে জমানো থাকলে, একজন মানুষ নিজের নিশ্চিত মৃত্যুর কথা বেমালুম ভুলে, স্বপ্ন দেখতে পারেন এমন এক স্বাধীন ভারতের, যার সবুজ বুকে থাকবে উদীয়মান লাল সূর্য, আর তাকে ঘিরে থাকবে প্রকৃতির নির্মল ছায়া – সেটা সত্যিই কল্পনার অতীত । আজ স্বাধীন ভারতবর্ষের গর্বিত ভারতীয়রা খোলা হাওয়ায় শ্বাস নিতে পারছে, দিনের জন্মের সাথে পুব আকাশে রবির কিরণ শরীরে নরম পরশ দিয়ে যাচ্ছে, সে তো এইসবই ভারত মাতার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের জন্য ।কেমন ছিল এইসব ক্ষীণজন্মা মহাপুরুষদের বাল্যকাল ? কেমন মায়ের গর্ভে জন্মেছিলেন এই সিংহ হৃদয় পুরুষ ? আজ তাঁর জন্ম বার্ষিকীতে একবার তাঁর বাল্যকালে ঘুরে আসতে ক্ষতি কি ?
ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক ছিলেন সমগ্র বাংলা তথা বাঙালীর গর্ব, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু | ভারতের স্বাধীন হওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর অসামান্য অবদান আমাদের কারোরই ভোলার নয় | তিনি দেশের জন্য যা করে গেছেন, তা হয়তো অনেক রাজনৈতিক নেতারাও ভাবতে পারবেন না তাদের জীবনে । এই মহান মানুষ আমাদের সকলের গর্বের নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর জন্ম হয় ১৮৯৭ সালের ২৩শে জানুয়ারী, বর্তমান ওড়িশার কটক শহরে | তাঁর বাবার নাম ছিলো শ্রী জানকীনাথ বসু । আর রত্নগর্ভা মা শ্রীমতী প্রভাবতী দেবী । বাবা জানকীনাথ বসু পেশায় ছিলেন কটক শহরের একজন বিখ্যাত আইনজীবী ।
নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু বেশ সচ্ছল পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন । তাঁরা ছিলেন চৌদ্দজন ভাই বোন । নেতাজী তাঁর বাবা মায়ের চোদ্দ সন্তানের মধ্যে নবমতম সন্তান | তবে নেতাজীর ভাই বোনদের মধ্যে তাঁর মেজদা ছিলেন শরৎচন্দ্র বসুর নামের সাথে আমরা বেশ পরিচিত । নেতাজির কথা উঠলেই বার বার তাঁর এই দাদার কথা উঠে আসে ।শরত বসু নেজাতিকে খুব ভালোবাসতেন এবং ছোট্ট নেতাজীরও খুব কাছের মানুষ ছিলেন তিনি |
নেতাজীর মধ্যে দেশপ্রেমের ব্যাপারটা প্রথম তাঁর বাবা জানকীনাথ বসুর কাছ থেকেই আসে । তাঁর বাবা যদিও কর্মজীবনে একজন ব্রিটিশ শাসিত সরকারী অফিসে কর্মরত ছিলেন, তবুও তিনি তৎকালীন কংগ্রেসের সমস্ত অধিবেশনে যোগদান করতেন এবং সাধারণ মানুষের খুব সেবা করতেন | তিনি স্বদেশী এবং জাতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির পক্ষপাতী ছিলেন | ছোট বেলা থেকেই বাবার এই সব কর্মকাণ্ড আগামী দিনের নেতাজী তৈরিতে সহায়তা করেছে ।
নেতাজী সুভাষের বাল্যকাল বিষয়ে আলোচনা করার আগে প্রথমেই বলে রাখা ভাল, অত্যন্ত মেধাবী এবং পড়াশুনার ক্ষেত্রে অতীব মনযোগী ছাত্র ছিলেন তিনি । তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় কটকের এক প্রোটেস্ট্যান্ড ইউরোপীয় স্কুল থেকে | ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত তিনি কটকের এই ইংরেজি স্কুলে পড়াশোনা করেন। বর্তমানে এই স্কুলটির নাম স্টিওয়ার্ট স্কুল (Stewart School)। এরপর তাঁকে ভর্তি করা হয় কটকের র্যাভেনশ কলেজিয়েট স্কুলে (Ravenshaw Collegiate School)। ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে এই স্কুল থেকে তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা দেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অনুষ্ঠিত এই পরীক্ষায় তিনি দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। এরপর ১৯০৯ সালে তিনি সেখান থেকে ভর্তি হন কটকের রাভেনশো কলেজিয়েট স্কুলে |
খুব ছোট বেলা থেকেই সুভাষ যে আগামী দিনে নেতৃত্ব দিতে চলেছেন সেটা বেশ ভালভাবেই বোঝা যেত । স্কুলে পড়ার সময়, তিনি সেই স্কুলের প্রিন্সিপাল বেনিমধাব দাসের ব্যক্তিত্বের উপর বিশেষভাবে প্রভাবিত হন এবং তাঁরই সহযোগীতায় ছোট্ট সুভাষ, স্বামী বিবেকানন্দের বই পড়তে আগ্রহী হয়েও পরেন | সুভাষচন্দ্র বোস পরবর্তীকালে তাঁর লেখায় উল্লেখ করেছিলেন যে, স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও লেখা বই তাঁকে একজন স্বাধীনতা সংগ্রামীতে পরিণত করেছিলো | স্বামীজির লেখা বই পড়েই তিনি তাঁর জীবনের আসল উদ্দেশ্য খুঁজে পান |
১৯১১ সালে নেতাজী, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত প্রেসিডেন্সি কলেজ (Presidency College)-এ ভর্তি হন। সেখানেই তাঁকে তাঁর সহপাঠীরা নেতা হিসাবে মেনে নিয়েছিল । ফলে ছাত্রদের মুখপাত্র হিসাবে তাকেই সবকিছু মোকাবিলা করতে হয় । শিক্ষক ও ছাত্রদের মধ্যে ভারত বিরোধী মত পার্থক্যর জন্য ভীষন সংঘাত শুরু হয় | এই কলেজের ইংরেজি অধ্যাপক ওটেন ভারত-বিদ্বেষী কথাবার্তার জন্য তিনি এর বিরোধীতা করেন। ফলে অধ্যাপক ওটেন-এর সমর্থকদের দ্বারা তিনি প্রহৃত হন। এরপর কলেজ কর্তৃপক্ষ কয়েকজন ছাত্রসহ সুভাষ বসুকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করে। এরপর তিনি স্যার আশুতোষ চৌধুরী সহায়তায় স্কটিশ চার্চ কলেজে (Scottish Church College) ভর্তি হন। এই কলেজে লেখাপড়ার সময় তিনি ইউনিভার্সিটি অফিসার্স ট্রেনিং কোর-এ যোগ দেন এবং সমরবিদ্যার প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দে এই কলেজ থেকে তিনি থেকে দর্শনে বি.এ (সম্মান) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তারপর নেতাজীর বিদেশ যাত্রা সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার জন্য । সেও এক অন্য ইতিহাস ।