ভারত ধর্মবিশ্বাসের দেশ, ভারত মন্দিরের দেশ । হিন্দু ধর্মে মন্দিরের স্থান সর্বোচ্চ । আর হিন্দু প্রধান দেশ ভারতবর্ষের ইতিহাস থেকে আমরা জানি, বিভিন্ন সময়ের,  বিভিন্ন বংশের হিন্দু রাজারা এই সমস্ত  মন্দির নির্মাণ ও মন্দিরের সাজসজ্জায় কোন কার্পণ্য করেননি কোন দিন । মন্দির যেন তাদের সৃষ্টিশীলতার প্রতীক । তাদের বৈভবের, তাদের ঐশ্বর্য-এর নিদর্শন । রাজারা সময়ের সাথে সাথে অকাতরে দিয়েছেন জমি, ধন সম্পদ । যা দিয়ে নির্মাণ হয়েছে অপূর্ব সব মন্দির । এছাড়া যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে তাঁরা যেমন দান করেছেন, তেমনি যুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার জন্য আশীর্বাদ গ্রহণ-এর উদ্দেশ্যে পূজিত দেবতাদের চরণে সমর্পণ করেছেন অঢেল ধন সম্পদ । আর এইভাবে বেড়েছে মন্দিরের সম্পত্তির পরিমাণ । তাছাড়া দর্শনার্থীরা যেসব মন্দিরে পূজা দিয়ে, তাদের মনের ইচ্ছা পূরণ হয়েছে, সেই সেই জাগ্রত মন্দির-এর যুগ যুগ ধরে ধর্মপ্রাণ হিন্দুরা বারবার গিয়েছে মন্দিরে তাদের আরাধ্য দেবতার কাছে । পূজিত দেবতার আশীর্বাদ লাভের আশায় এই মন্দিরগুলিতে রোজ হাজার হাজার পূণ্যার্থী আসেন । তাই এই সব মন্দির কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে প্রাচীন সব শহর । ভারতের শীর্ষ দশটি ধনী সম্পদশালী মন্দির সম্পর্কে অজানা তথ্য নীচে জানানো হল ।

১) কাশীর বিশ্বনাথ মন্দির । দেবাদি দেব মহাদেব-এর এই মন্দির, ভারতের ধনী মন্দির গুলির মধ্যে অন্যতম । এটি মন্দিরের শহর কাশীতে অবস্থিত । গঙ্গা নদীর তীরে কাশীর বিশ্বনাথ মন্দির বিভিন্ন ধর্মের রাজাদের দ্বারা অতীতে বারবার লুট হয়েছিল । তবু মন্দিরটি বারবার তার মহিমা পুনরুদ্ধার করেছে । এই মন্দিরে প্রতিদিন হাজার হাজার পূণ্যার্থী আসেন বাবা শিবের মাথায় জল ঢালতে ও পূজা নিবেদন করতে । আর সোমবারে সবচেয়ে বেশি ভিড় হয় । শ্রাবণ মাসের পূর্ণ সময়, প্রতিদিন অগণিত ভক্ত আসেন । ২০১৬ সালের হিসেব অনুযায়ী ৩০ লক্ষ দেশীয় দর্শনার্থী ও দুই লক্ষ বিদেশী দর্শনার্থী এই মন্দির দর্শন করেছেন । এই মন্দিরের বাৎসরিক অনুদান ৫ থেকে ৬ কোটি টাকা । কাশীর বিশ্বনাথ মন্দিরের তিনটি চূড়ার মধ্যে দুটি সোনা দ্বারা আচ্ছাদিত ।


Jagannath Temple
২) নয় নম্বরে আছে পুরীর জগন্নাথ মন্দির । ওড়িশার পুরী শহরে অবস্থিত এই জগন্নাথ মন্দির ওড়িয়া এবং হিন্দুদের কাছে অন্যতম পবিত্র দর্শনীয় স্থান । বছরের প্রতি দিন এই মন্দিরে অসংখ্য পুণ্যার্থীর আসেন । এই মন্দিরের আরাধ্য দেবতা হলেন ভগবান জগন্নাথ, বলরাম ও তাদের একমাত্র বোন সুভদ্রা । জগন্নাথ মন্দিরের স্থাপত্য সত্যিই বিস্ময়কর । রথযাত্রার সময় এই মন্দির সংলগ্ন এলাকায় আগমন হয় লক্ষ লক্ষ ভক্তের রথের দড়ি টানার জন্য । এই মন্দিরের বিগ্রহের বিশেষত্ব হলো, এই বিদ্রোহ নিম কাঠের তৈরি । প্রতিবছর নতুন বিগ্রহ তৈরি করা হয় । এই মন্দিরের চারটি সিংহ দরজা আছে । ওড়িশা সরকারের এক হিসেব অনুযায়ী এই মন্দিরে সম্পত্তির পরিমাণ ৩০০ কোটির বেশি । আনুমানিক ৩০ হাজার দর্শনার্থী প্রতিদিন এবং রথের মাসে প্রতিদিন ৭০ হাজারের মতো পুণ্যার্থীর এই মন্দিরে পূজা দেয় । প্রতিদিন অনুদান হিসেবে প্রাপ্ত অর্থের পরিমাণ প্রায় কোটি টাকা ।


Meenakshi Temple

৩) আট নম্বরে আছে মীনাক্ষী মন্দির । তামিলনাড়ুর মাদুরাই শহরে এই মন্দির অবস্থিত । বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য এই মন্দিরের আরাধ্য দেবী মীনাক্ষী । তিনি উৎকর্ষ-এর দেবী । মীনাক্ষী ভগবান সুন্দরেশ্বরের স্ত্রী । প্রতিদিন এই মন্দিরে ভক্তদের থেকে প্রাপ্ত অনুদানের পরিমাণ পাঁচ থেকে ছয় লক্ষ টাকা । বাৎসরিক অনুদান প্রায় ১০ থেকে ১২ কোটি । এই মন্দিরের কারুকার্য দক্ষিণ ভারতের সুন্দর স্থাপত্য দিয়ে গড়া । এই মন্দিরে ১৪ টি স্তম্ভ আছে, যাদের প্রত্যেকটির উচ্চতা ৪০ থেকে ৫০ মিটার ।


Somnath Temple

৪) সাত নম্বরে আছে গুজ্রাতের সোমনাথ মন্দির । গুজরাটের সোমনাথ মন্দির প্রাচীনকাল থেকেই বারবার ইতিহাসের পাতায় উঠে এসেছে তার ধন-সম্পদ বারবার বিদেশি আক্রমণকারীদের লুণ্ঠনের কারণে । কথিত আছে মোহাম্মদ ঘোরি এই মন্দির ১৭ বার লুণ্ঠন করেছিলেন । এবং মন্দিরের প্রচুর ক্ষতি করেছিলেন । তবুও বারবার এই মন্দির ভারতীয় রাজারা যারা নির্মাণ করেছেন । অতীতে এই মন্দির ভারতের সবচেয়ে বড় সম্পদশালী পুরনো মন্দির ছিল । এটি মহাদেব শিবের বার জ্যোতি লীঞো-এর মধ্যে একটি । সারা ভারত এবং বিদেশ থেকে বহু পুণ্যার্থী আসেন এই মন্দির দর্শন ও পূজা নিবেদন করতে । এই মন্দিরের কারুকার্য সত্যিই অতুলনীয় । সমুদ্র তীরবর্তী এই মন্দির আগেরকার দিনের রাজাদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতির নিদর্শন আমাদের আজও অবাক করে ।


Golden_Temple_Nightview

৫) ছয় নম্বরে আছে স্বর্ণমন্দির । পাঞ্জাবের অমৃতসরে স্বর্ণমন্দির আসলে গুরুদুয়ারা শিখ ধর্মাবলম্বীদের তথা সকল ধর্ম মানুষের কাছে এক অন্যতম দর্শনীয় স্থান । এই মন্দিরের বিশেষত হল এখানে কোন মূর্তি বা বিগ্রহ নেই । উল্লেখ্য এই মন্দিরের লঙ্গর খাণায় প্রতিদিন 1 লক্ষ লোকের খাবার তৈরি করা হয়, যা সারা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি । এই মন্দির সম্পূর্ণভাবে সোনার আচ্ছাদিত । এছাড়াও এখানে রুপার কাজের নিদর্শন দেখা যায় । ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে অগণিত মানুষ এখানে আসেন । বড় বড় আমলারা এখানে বিনা পারিশ্রমিকে শ্রম দান করেন এবং লঙ্গরখানা থেকে খাবার গ্রহণ করেন ।


Siddhivinayak-Temple-In-Mumbai

৬) পাঁচ নম্বরে আছে মহারাষ্ট্রের সিদ্ধিবিনায়ক মন্দির । মহারাষ্ট্রের সবচাইতে জনপ্রিয় মন্দিরের মধ্যে অন্যতম এই মন্দির । এই মন্দিরের আরাধ্য দেবতা গণেশ । ভারতের অর্থনৈতিক রাজধানী মুম্বাইয়ে অবস্থিত হওয়ায় এবং ভক্তের সকল মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করার জন্য এই মন্দিরে পুণ্যার্থী ভক্তদের আনাগোনা খুব বেশি । প্রতিদিন এই মন্দিরে ভক্তসংখ্যা ২৫ হাজারের  আশেপাশে থাকে এবং গণেশ চতুর্থী সময় তার দু লক্ষ পর্যন্ত হয় । এর বার্ষিক ভক্তদের অনুদান ৪৫ কোটি থেকে ১২৫ কোটি বা তারও বেশি হয় । বি গ্রহের ওপর ৩.৭ কেজি ওজনের সোনার গম্বুজ আছে । প্রতিদিন কোন না কোন বলিউড ফিলমস্টার, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এই মন্দিরে পূজা দিয়ে ভগবান গণেশের আশীর্বাদ গ্রহণ করেন ।


sai mandir

৭) সিরিডির সাই বাবা মন্দির আছে চার নম্বরে । ভারতের মহারাষ্ট্রের অপর একটি ধনী মন্দির হল এই মন্দির । যেখানে সকল ধর্মের, জাতের মানুষ আসে, তাদের আরাধ্য দেবতা সাই বাবা । এখানে মানুষ দেবতা রূপে পূজিত হয় । যদিও কথিত আছে এই সাইবাবা সকল প্রকার মানুষের মনের ইচ্ছা পূরণ করেন অর্থাৎ তিনি ছিলেন ঐশ্বরিক ক্ষমতার অধিকারী । আর সেজন্য পুণ্যার্থীরা এই মন্দিরে সারা বছর ধরে তাদের মনের ইচ্ছা পূরণের জন্য আসেন । ভারতের চতুর্থ সম্পদশালী এই মন্দিরে বছরে ৩০০ কোটির বেশি সোনার অলংকার ও এক কোটির মত রূপার অলঙ্কার ভক্তরা দান করে । এই মন্দিরের বাৎসরিক অনুদান ৩৬০ কোটি টাকার মত ।


vaishno devi temple

৮) তৃতীয় স্থানে আছে বৈষ্ণদেবী মন্দির । সারা বিশ্ব থেকে অসংখ্য পুণ্যার্থী জম্মু-কাশ্মীরের কাটালায় অবস্থিত এই মন্দির দর্শনের জন্য সারা বছরে আসে তাদের মনস্কামনা পূরণ করার জন্য । মাথা সতীর ৫১ পীঠের মধ্যে অন্যতম এই মন্দির । মাতা খুবই জাগ্রত এখানে । এই মন্দিরের রাস্তা দুর্গম হলেও ভক্তদের ভিড় কোনদিন কম হয় না । এই মন্দিরে বার্ষিক অনুদানের পরিমাণ ৫০০ কোটি টাকার কাছাকাছি ।


Tirumala temple

৯) তিরুমালা তিরুপতি ভেঙ্কটেশ্বর মন্দির দুই নম্বরে আছে । অন্ধ প্রদেশের অন্তর্গত তিরুপতি মন্দির ভারতের দ্বিতীয় ধনবান মন্দির । বিশ্বের হিন্দুদের কাছে পবিত্র দর্শনীয় স্থান এই মন্দিরে প্রতিদিন প্রায় ৬০ হাজারের মতো প্রার্থী আসেন মন্দিরে পূজা নিবেদন করতে । এই মন্দিরের আরাধ্য দেবতা ভেঙ্কটেশ । প্রায় ১০০ কেজি সোনার তৈরি অলঙ্কারে ভূষিত এই  আরাধ্য দেবতা । এখান কার মন্দিরের প্রসাদ লাড্ডূ বিক্রি করে বছরে প্রায় ১৩ কোটি মার্কিন ডলার আয় হয় । প্রায় ৭০০ কোটি টাকা বাৎসরিক অনুদান আসে ভক্তদের কাছ থেকে । এখানে ভক্ত রা তাদের চুল দান করেন । পাহাড়ের উপরে স্থিত এই মন্দির ভাস্কর্য ও স্থাপত্য শিল্পের এক বিখ্যাত নিদর্শন ।


Sri-Padmanabhaswamy-Temple-Kerala

১০) পদ্মনাভ স্বামী মন্দির ভারতের অন্যতম ধনী মন্দির । বর্তমানে দেখা গেছে কেবল মাত্র ভারত নয়, সারা বিশ্বে সর্ব কালের সেরা ধর্ম প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এই মন্দির ধনী তম । কেরালার তিরুবান্থাপুরাম-এ অবস্থিত এই মন্দিরের আরাধ্য দেবতা ভগবান শ্রী বিষ্ণু । এই মন্দিরের নীচের গোপন ঘর থেকে কম বেশী দু হাজার কোটি টাকার সোনা পাওয়া গেছে । এছাড়া ম্নি-মানিক্য, হিরে-জহরত, চুনি-পান্নার ঐতিহাসিক মূল্য না ধরেও যদি বাজার মূল্য ধরা হয়, তাহলেও তার মূল্য ট্রিলিয়ন ডলারে দাঁড়াবে । এছাড়াও পাওয়া গেছে ভগবান শ্রীবিষ্ণুর আনুমানিক পাঁচশ কোটি টাকা মূল্যের সোনার মূর্তি । যদিও এখনো এই মন্দিরের সব কয়টি গোপন কক্ষ খোলা সম্ভব হয়নি । সারা বছর ধরে অসংখ্য পুণ্যার্থী আসেন এই মন্দিরের বিগ্রহ দর্শন ও পূজা করতে ।

Kajal Paul is one of the Co-Founder and writer at BongDunia. He has previously worked with some publishers and also with some organizations. He has completed Graduation on Political Science from Calcutta University and also has experience in News Media Industry.

Leave A Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.