ইতিহাসের পাতায় পীর তাহির আলী (Hazrat Pir Ali Muhammad Tahir) হয়ত বড় কোন নাম নয় কিন্তু দক্ষিণ বঙ্গ তথা পীরালি ব্রাহ্মন ও রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষ খুজতে গেলে পীর তাহির একটি অন্যতম নাম। ইসলাম ধর্ম প্রচারে হযরত উলুঘ জাহান (র.) একটি অন্যতম নাম। এই খানজাহানের অন্যতম শিষ্য পীর তাহির আলী।

নড়াইল জেলার হিন্দু এক ব্রাহ্মন ছিলেন।  যার নাম ছিল গোবিন্দ ঠাকুর। দক্ষিনাঞ্চলের ইতিহাস রচয়িতা সতীশ চন্দ্র মিত্র তার তেমন পরিচয় জানান নাই। এ অঞ্চলের আরেক ইতিহাস রচয়িতা আ.ফ.ম জলিল কিছুটা আলোকপাত করেন। এই ঐতিহাসিকের মতে খান জাহানের পরশে গোবিন্দ ঠাকুর ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং প্রধান সহচরে পরিনত হন। তাহিদের কাজ এতই জননন্দিত ছিল তার কাজ দেখে অনেকেই মুসলিম ধর্মে দীক্ষা নেন। পীর তাহির আলি নড়াইলের পেরিলি গ্রামে বাস করতেন। নীলকান্ত পীর তাহির আলী (Hazrat Pir Ali Muhammad Tahir) সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন-

‘পীর আলী নাম ধরে পীরাল্যা গ্রামে বাস

যে গাঁয়েতে নবদ্বীপের হইলো সর্বনাশ।’

‘বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস’ বইয়ে ঘটকদিগের পুথিতে পীর তাহির আলী সম্পর্কে বলা হয়।

খানজাহান মহামান পাতশা নফর।

যশোর সনন্দে লয়ে করিল সফর।।

তার মুখ্য মহাপাত্র মামুদ তাহির।

মারিতে বামুন বেটা হইল হাজির।।

পূর্বেতে আছিল সেও কুলীনের নাতি।

মুসলমানী রূপে মজে হারাইল জাতি।।

পীর আলী নাম ধরে পীরাল্যা গ্রামে বাস।

যে গাঁয়েতে নবদ্বীপের হইল সর্বনাশ।।

সুবিধা পাইয়া তাহির হইল উজীর।

চেঙ্গুটিয়া পরগণায় হইল হাজির।।

ঐতিহাসিকদের মতে হযরত পীর আলী মুহাম্মদ তাহির (Hazrat Pir Ali Muhammad Tahir) পয়গ্রাম অঞ্চলের শাসনকর্তা ছিলেন বলে জানা যায়। জানা যায়, পরে তিনি খলিফাতাবাদ রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। প্রখ্যাত গবেষক জনাব অধ্যাপক আবূ তালিব বৈষ্ঞব ধর্মের প্রবক্তা শ্রীচৈতন্যের প্রচারিত আদর্শ সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন, “সত্যি বলতে কি, পীরালি আবু তাহিরই ছিলেন শ্রীচৈতন্যের পূর্বসূরী। আবূ তাহিরের আবির্ভাব যাদেরকে পবিত্র ইসলাম ধর্মের দিকে আকৃষ্ট করেছিল, শ্রী চৈতন্য তাদেরকে বৈষ্ঞব ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট করতে চেয়েছিলেন। ধর্ম প্রচারের ব্যাপারে পীরালী সাহেব শ্রীচৈতন্যের দিশারী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। শ্রীচৈতন্য তাঁরই পথের অনুসারী ছিলেন। আরও বলা যেতে পারে, নির্যাতিত হিন্দু পীরালী সমাজ একাধারে চৈতন্যের ধর্ম ও ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়ে শান্তি প্রাপ্ত হয়েছিলেন।

Hazrat Pir Ali Muhammad Tahir bengali

পীর আলী মুহাম্মদ তাহিরের প্রধান কর্মকেন্দ্র হয় পয়গ্রাম কসবায়।“হযরত খানজাহান এই গ্রামটিকে তাঁর বিশাল সাম্রাজ্যের ভবিষ্যত রাজধানী শহর করার সুসংবাদ প্রদান করেন। এবং অবিলম্বে গ্রামটিকে একটি ‘কসবা’ বা শহরে পরিণত করেন। হযরত পীর আলী’র নিকট এত অধিক সংখ্যক ব্রাহ্মণ মুসলমান হন যে, নবদ্বীপে ব্রাহ্মণ আর ছিলনা বললেই চলে। এজন্য অন্যান্য হিন্দু ব্রাহ্মণগণ ভয় পেয়ে যান ও চিন্তিত হয়ে পড়ে। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে এর স্বাক্ষ্য মেলে-

পীরাল্যা গ্রামেতে বৈসে যবেত যবন।

উচ্ছন্ন করিল নবদ্বীপের ব্রাহ্মণ।।

ব্রাহ্মণ জবনে বাদ যুগে যুগে আছে।

বিষম পীরাল্যা গ্রাম নবদ্বীপের কাছে।।

কবি আরো বলেন-

পীর আলী নাম ধরে পীরাল্যা গ্রামে বাস।

যে গায়েতে নবদ্বীপের হৈল সর্ববনাস।।

অথবা

“বিষম পীরাল্যা গ্রাম নবদ্বীপের আড়ে।

৮৬৩ হিজরী মোতাবেক ১৪৫৯ সালে এ মহান কামেলে দ্বীন ও ইসলাম প্রচারক ইন্তিকাল করেন। তাঁর মাজার বাগেরহাট হযরত উলূঘ খান জাহান আলীর(র) মাজারের পাশেই আছে। এ সম্বন্ধে সতীশ চন্দ্র মিত্র লিখেছেন, “মুহাম্মদ তাহির এখানে মারা যান নাই, এখানে মাত্র তাঁহার একটি শূন্যগর্ভ সমাধিবেদী গাঁথা রহিয়াছে।…..বন্ধুর স্মৃতি চিহ্ন রাখা কর্তব্য এই বুদ্ধিতে খাঁ জাহান মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্বে সেই একই জেলহ্জ্জ মাসে মুহাম্মদ তাহিরের জন্য এই স্মৃতি স্তম্ভ গঠিত করিয়া রাখিয়া যান। সমাধির উপরিভাগটি প্রায় খান জাহানে সমাধির ন্যায়, তবে ইহার ভিতরে কিছুই নাই, সিঁড়ি দিয়া তন্মধ্যে অবতরণ করা যায়।”

তাঁর শিলালিপিতে লেখা আছে, “হাজিহি রওজাতুন মুবারাকাতুন মির রিয়াজিল জান্নাতি ওয়া হাজিহি সাখরিয়া তুল লিহাবীবিহি এসমুহু মুহাম্মদ তাহির ছালাছা সিত্তিনা ওয়া সামানিয়াতা।” অর্থাৎ এই স্থান বেহেশতের বাগিচা সদৃশ এবং ইহা জনৈক বন্ধুর মাযার, নাম-আবু তাহির, ওফাতকাল-৮৬৩ হি/১৪৫৯ খৃষ্টাব্দ। এই একই বৎসর হযরত খান জাহান (রঃ) এর ওফাত হয়।

এই পীর তাহির আলীর (Hazrat Pir Ali Muhammad Tahir) সংস্পর্শে কুশারী পরিবারদের একটি অংশ সংস্পর্শ দোষে তৎকালীন সমাজে জল অচল হয়। “গন্ধে অন্ধ ভোজন” সমাজ থেকে বিচ্যুত একটি ধারা জোড়াসাকোর ঠাকুর পরিবার। আমরা আগামি পর্বে সে কাহিনী উল্ল্যেখ করব।

Mr. Shuva is a News and Content Writer at BongDunia. He has worked with various news agencies all over the world and currently, he is having an important role in our content writing team.

Leave A Reply