বং দুনিয়া ওয়েব ডেস্কঃ সালটা তখন ১৯৩৪ । নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু তখন অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় অবস্থান করছেন । ১৯৩২-এর ফেব্রুয়ারী থেকে অসহযোগ আন্দোলনের সময় গ্রেপ্তার হয়ে জেলে যাওয়ার সময় থেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। এরপর ভিয়েনায় তিনি শারীরিক অসুস্থতার মধ্যে তখন দিন কাটাচ্ছেন । এদিকে তাঁর নির্বাসনও চলছে । ঠিক সেই সময় শারীরিকভাবে অসুস্থ থাকা সত্ত্বেও তিনি তাঁর প্রম বই “ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল” লেখা শুরু করেন । নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর স্ত্রী এমিলির সাথে এই বই লেখার সুত্র ধরেই পরিচয় হয় ।
বই লেখার সময় নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু বইটির লেখা টাইপ করার জন্য তিনি একজন সেক্রেটারি খুঁজছিলেন। ড. রমণী মাথুরের মাধ্যমে তিনি পরিচিত হন এমিলি শেঙ্কলের সাথে। কথা বার্তা বলার পর এমিলিকে তার সেক্রেটারির কাজে নিয়োগ দেয়া হয়। এমিলি শেঙ্কলের পরিবার ছিল তখনকার দিনে বেশ রক্ষণশীল অস্ট্রীয় পরিবার । পরিবারের পক্ষ থেকে এমিলিকে চার্চের নান হবার জন্য পরিবার থেকে চাপ দেওয়া হচ্ছে । কিন্তু এমিলি পারিবারিক চাপ উপেক্ষা করে সেক্রেটারিয়াল পড়াশোনা করেন। যদিও একজন ভারতীয়র সেক্রেটারির কাজ করার ব্যাপারে এমিলির পিতার আপত্তি ছিল। কিন্তু মা- এবং বোনকে রাজি করিয়ে এমিলি কাজটি নেন।
তথ্য বলছে, ১৯৩৪ থেকে ১৯৪২ পর্যন্ত সময়টিতে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু এমিলিকে ১৬০টির মত চিঠি লেখেন। বেশিরভাগ চিঠিতেই বিভিন্ন কাজের দিক নির্দেশনা দিয়ে লেখা । তবে এমিলিকে লেখা নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর সেই সব চিঠিতে প্রায়ই ফুটে উঠেছে এমিলির প্রতি গভীর অনুরাগ, স্নেহ এবং মাঝে মধ্যে কিঞ্চিত ঈর্ষাকাতরতা । একবার নেতাজী এমিলিকে দিয়ে ভারতীয় পত্রিকা দ্যা হিন্দুতে আর্টিকেল লিখিয়েছিলেন । তবে লেখাগুলো নিজে এডিট করে দিয়েছেন এবং এমিলির বোঝার জন্য তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বলকান অঞ্চলের ভু-রাজনৈতিক বিষয়ে চমৎকার বিশ্লেষণ লিখেছেন। তবে দেখা যায়, ঈর্ষা মিশ্রিত কেয়ারিং ফুটে উঠে ৩/৫/১৯৩৬ এর চিঠিতে। যেখানে সুভাস বসু বলছেন, ” ভারতীয়দের পাঠদান করার সিদ্ধান্তটি কেয়ারফুলি ভেবে নিও, কারণ সাধারণত ওরা এমন কাউকে চায় যে ফ্লার্ট করবে এমনকি নাচও শেখাবে। এমন কিছু মহিলা আছে এবং আমি আতংকিত যে ওরা তোমাকেও না অমন একজন ভেবে বসে! ড. সেন তোমার সাথে কেমন আচরণ করছে?” আবার দেখা গেছে যে সুভাস বসু এমিলিকে বকাবকিও করছে কারণ এমিলি তাকে সুটকেস কিনে তাতে শীতের জামা কাপড় ভরে পোস্টে পার্সেল করে দিয়েছে। অর্থের এমন অপ্রয়োজনীয় শ্রাদ্ধ দেখে সুভাস বসু এতে ভীষণ বিরক্ত হন।
এই সময়টিতেই নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর সাথে কাজ করার সময় দুজনের মাঝে ধীরে ধীরে হৃদ্যতা তৈরি হয়। ১৯৩৭ সালে তারা বিয়ে করেন। যদিও এই বিবাহের কোন অফিসিয়াল প্রমাণ নেই। ভিয়েনায় অবস্থানকালে ব্রিটিশ সরকার স্বাস্থ্য পুরুদ্ধার করার জন্য নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুকে ভিয়েনায় যাবার অনুমতি দিলেও শর্ত ছিল চিকিৎসার খরচ তাঁর পরিবারকেই দিতে হবে।
এমিলি শেঙ্কল যখন নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর সামনে এসেছিলেন ইন্টারভিউ দিতে তখন তাঁর বয়স ছিল ২৩ বছর । আর নেতাজীর তখন ৩৭ চলছে । সুন্দরী অস্ট্রিয়ান ওই যুবতীকেই সহকারী হিসাবে কাজে নিয়োগ করার আগে পর্যন্ত তিনি ধারণাও করতে পারেন নি যে ওই অস্ট্রিয় যুবতী তাঁর জীবনে একটা নতুন ঝড় তুলে দিতে পারেন। সুভাষ চন্দ্র বসুর বড়ভাই শরৎ বসুর নাতি ও প্রখ্যাত ঐতিহাসিক সুগত বসু নিজের বই ‘হিজ ম্যাজেস্টিজ অপোনেন্ট – সুভাষ চন্দ্র বসু এন্ড ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল এগেইনস্ট এম্পায়ার’-এ লিখেছেন, এমিলির সঙ্গে সাক্ষাতের পরেই সুভাষের জীবনে একটা নাটকীয় পরিবর্তন এসেছিল। সুগত বসুর মতে তার আগে পর্যন্ত সুভাষ চন্দ্র বসুর জীবনে প্রেম বা বিয়ের বেশ কিছু প্রস্তাব এসেছিল। সেসবে তাঁর কোনও আগ্রহই ছিল না। কিন্তু এমিলির সৌন্দর্য্য সুভাষের ওপরে যেন কী একটা জাদু করে দিল।
তবে নেতাজীর বিবাহিত জীবন ছিল মাত্র ৯ বছর । কিন্তু দেশের জন্য নিবেদিত প্রান নেতাজী তাঁর দাম্পত্য জীবনও উৎসর্গ করেছিলেন দেশের সেবায় । ফলে ৯ বছরের বিবাহিত জীবনের মধ্যে মাত্র ৩ বছর তাঁরা একসাথে ছিলেন । এমিলি অবশ্য দীর্ঘদিন সুভাষ চন্দ্র বসুর ফিরে আসার অপেক্ষায় ছিলেন। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে তিনি একাই মেয়েকে বড় করেছেন এবং মায়ের দেখভাল করেছেন। যদিও এমিলি কখনোই ভারতে আসেনি কিন্তু ভারতে সুভাষ চন্দ্র বসুর পরিবারের সাথে তার যোগাযোগ ছিল।
২৯শে মে ১৯৪২ সালে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু হিটলারের সাথে দেখা করে ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামে জার্মানির সাহায্য চায়। ব্রিটিশবিরোধী লড়াইয়ে ভূমিকা রাখতে চায়। কিন্তু তাদের সাক্ষাতে উল্লেখযোগ্য কোন ফলাফল হয় না। সুভাষ চন্দ্র বসু দিন দিন নাৎসিদের উপর ভরসা হারাচ্ছিলেন এবং জাপানের সাথে ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামে যুক্ত হতে আগ্রহী হচ্ছিলেন। ২৯শে নভেম্বর ১৯৪২ সালে তাদের ঘরে আসে তাদের একমাত্র কন্যাসন্তান অনিতা এবং ৮ই ফেব্রুয়ারি ১৯৪৩ সালে সুভাস বসু জার্মান সাবমেরিনে করে জাপানের উদ্দেশ্যে রওনা করেন। সেটাই ছিল নেতাজীর সাথে তাঁর স্ত্রী ও কন্যার শেষ বিদায়।