বং দুনিয়া ওয়েব ডেস্কঃ নেতাজী তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন, “Vivekananda entered my life”. ত্যাগে বেহিসাবি, কর্মে বিরামহীন, প্রেমে সীমাহীন স্বামীজির জ্ঞান ছিল যেমন গভীর তেমনি বহুমুখী । ………… আমাদের জগতে এরূপ ব্যাক্তিত্ব বিরল । স্বামীজি ছিল পৌরুষসম্পন্ন পূর্ণাঙ্গ মানুষ ……… ঘণ্টার পর ঘণ্টা বলে গেলেও সেই মহাপুরুষের বিষয় কিছুই বলা হবে না, এমনই ছিলেন তিনি মহৎ, এমনই ছিল তাঁর চরিত্র । যেমন মহান, তেমন জটিল । আজ তিনি জীবিত থাকলে আমি তাঁর চরণেই আশ্রয় নিতাম” । সুতরাং স্বামী বিবেকানন্দ নেতাজীর জীবনে কতখানি জায়গা অধিকার করে ছিল সেটি নেতাজীর কথা থেকেই জানা যায় ।নেতাজীর অন্তরঙ্গ বন্ধু চারুচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায় একবার এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, “ সুভাষের সাথে আবাল্য খুব ঘনিষ্ঠভাবে মিশেছি । তাই জোর করে বলতে পারি, বিবেকানন্দের প্রভাব যদি সুভাষের উপর না পড়ত, তাহলে সুভাষ “সুভাষ” হত না, “নেতাজী” হত না । হয়ত অ্যাডভোকেট জেনারেল হত, কিম্বা ব্যারিস্টার হত, কিন্তু আইএনএ যে ফর্ম করেছে সেই “নেতাজি সুভাষচন্দ্র”কে আমরা পেতাম না ।”
সুভাষ চন্দ্র বসুর বয়স যখন ১৩/১৪ বছর তখন তাঁদের এক আত্মীয় কটকে তাঁদের বাড়ীতে বেড়াতে আসেন। তিনি তাঁদের বাড়ীর নিকটেই থাকতেন । নেতাজী একদিন তাঁর বাড়ীতে বেড়াতে যান এবং তাঁর ঘরে স্বামী বিবেকানন্দের অনেকগুলো বই দেখতে পান। তিনি স্বামীজীর বইগুলো তাঁর কাছ থেকে আনেন এবং পড়েন। এভাবে স্বামী বিবেকানন্দ ও তাঁর গুরুদেব শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের প্রতি তিনি আকৃষ্ট হন। স্বামীজীর বক্তৃতা ও চিঠিপত্রগুলো তাঁকে বিশেষভাবে উদ্বুদ্ধ করে।
স্বামীজীর বক্তৃতাবলী ও শ্রীরামকৃষ্ণের উপদেশ পাঠ করার পর তিনি পড়াশোনায় অমনোযোগী হয়ে পড়েন। আধ্যাত্মিক উন্নতি করার জন্য যোগ অভ্যাস শুরু করেন। কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে দরিদ্রনারায়ণের সেবায়, রুগ্নের শুশ্রূষায় এবং দুঃস্থের দুঃখ মোচনে অধিকাংশ সময় ব্যয় করতেন। কি করে স্বামীজীর আদর্শকে তাঁর জীবনে সফল করবেন, সেটাই ছিল তখন নেতাজীর একমাত্র চিন্তা।
নেতাজীর ছাত্র জীবনে বিবেকানন্দ কতখানি জুড়ে ছিল সেটি একটা উদাহরণ দিলেই বুঝতে সুবিধা হবে । সাফল্যের সাথে
প্রবেশিকা পাশ করার পর তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সী কলেজে আই.এ ভর্তি হন। এই কলেজে পড়ার সময় তিনি স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শ ও ধর্ম চর্চায় আরও বেশী মন দেন। আই.এ. পড়ার একপর্যায়ে মানব সেবার উদ্দেশ্যে তিনি গৃহ ত্যাগ করেন। এসময় তিনি ভারতবর্ষের বিভিন্ন তীর্থস্থান ঘুরে বেড়ান। কয়েক মাস পর বাড়িতে ফিরে আসেন। বাড়িতে আসার পর তিনি টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে অনেক দিন ভোগেন। এরপর বাড়ির লোকজন এবং বন্ধুবান্ধব তাঁকে বোঝাতে শুরু করেন আবার পড়াশুনা চালিয়ে যাবার জন্য । সুস্থ হওয়ার পর বার্ষিক পরীক্ষার পূর্বে তিনি পড়াশুনায় মনোযোগ দেন।
নেতাজী ছিলেন খুব ছোটবেলা থেকেই অত্যন্ত মেধাবী এবং পড়াশোনায় মনোযোগী । ১৯০৮ সাল। তখন বালক সুভাষ চন্দ্র বসু কটকের রাভ্যেনশ কলেজিয়েট স্কুলে ফোর্থ ক্লাসে পড়াশুনা করছেন। পড়াশুনায় তিনি খুব ভাল ছিলেন। প্রতি বৎসর তিনি ক্লাশে প্রথম স্থান অর্জন করতেন। তবে ছোটবেলা থেকে ইংরাজি মাধ্যমের স্কুলে পড়াশুনা করার ফলে বাংলা ছাড়া অন্য সকল বিষয়েই তিনি দক্ষ ছিলেন। কারণ পাদ্রীদের স্কুলে বাংলা ভাষা শিক্ষা দেবার কোন ব্যবস্থাই ছিল না। একবার ক্লাসে গরু সম্বন্ধে বাঙ্গলায় একটি রচনা লিখিতে দেওয়া হয়। নেতাজীর লেখা গরু রচনাটির এক বর্ণও ঠিক হয়নি । শিক্ষক মহাশয় ক্লাসের মধ্যে তার রচনাটি পড়ে শোনালেন। তারপর ক্লাসে হাসির রোল পড়ে যায়। এসময় সুভাষ চন্দ্র লজ্জায় লাল হয়ে যান। ইতিপূর্বে পড়াশুনার জন্য তিনি কখনও এইরূপ বিদ্রুপের সম্মুখ হননি। যার ফলে তার আত্মসম্মানে বিশেষ আঘাত লাগে। এসময় তিনি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেন যে, বাংলা ভাষা তিনি ভাল করে শিখে এর প্রতিশোধ নিবেন। প্রতিজ্ঞা অনুযায়ী পুরোদমে বাংলা শেখেন এবং তিনি বাৎসরিক পরীক্ষার বাংলায় সর্বোচ্চ নম্বর পান।
তদানীন্তন যুবক সমাজে বিবেকানন্দ একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে ছিলেন । কিন্তু যুবসমাজকে ঐক্যবদ্ধ করতে নেতাজীর জুড়ি মেলা ভার ছিল । ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে ভারতবর্ষ থেকে বিতাড়িত করার জন্য যে সকল মহান ব্যক্তি, বিপ্লবী, লড়াকু যোদ্ধা জীবন উৎসর্গ করেছেন, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু তাঁদের মধ্যে অন্যতম। অহিংসায় নয়, উদারতায় নয়, শক্তি প্রয়োগ করেই ব্রিটিশকে ভারত থেকে তাড়াতে হবে- এই মন্ত্রকে ধারণ করে যিনি আমৃত্যু লড়াই-সংগ্রাম চালিয়েছেন ব্রিটিশ শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে। তাই তিনি অকপটে দ্বিধাহীনভাবে ভারতের যুব সম্প্রদায়কে বলতে পেরেছিলেন “তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব”।
ছেলেবেলা থেকে তিনি মেধাবী ও বুদ্ধিমান ছিলেন। পড়াশুনা করার পাশাপাশি তিনি নিয়মিত ব্যায়াম চর্চা করতেন। বাগানে তরিতরকারি ও ফুল গাছের প্রতি তার খুব ঝোঁক ছিল। প্রত্যহ তিনি বাড়ির মালিদের সাথে গাছে জল দিতেন। তিনি প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হতেন । এই সময় রাভ্যেনশ কলেজিয়েট স্কুলের প্রধান শিক্ষক বেণীমাধব দাসের প্রভাব সুভাষ চন্দ্রের উপর পড়ে। সুভাষ চন্দ্র আত্মজীবনীতে বলেছেন যে, “প্রথম দর্শনেই তার প্রখর ব্যক্তিত্বে আমি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। তখন আমার বয়স বারোর কিছু বেশি হবে। এর আগে আর কাউকে আন্তরিকভাবে শ্রদ্ধা করেছি বলে মনে পড়ে না। বেণীমাধব দাসকে দেখবার পর শ্রদ্ধা কাকে বলে মনে প্রাণে অনুভব করলাম। কেন যে তাঁকে দেখলে মনে শ্রদ্ধা জাগতো তা বোঝবার মত বয়স তখনো আমার হয়নি। শুধু বুঝতে পারতাম, তিনি সাধারণ শিক্ষকের পর্যায়ে পড়েন না। মনে মনে ভাবতাম, মানুষের মতো মানুষ হতে হলে তার আদর্শেই নিজেকে গড়তে হবে।”
ছাত্র জীবনে, স্বামীজীর বক্তৃতা ও চিঠিপত্রগুলি নেতাজীকে বিশেষভাবে উদ্বুদ্ধ করে। বিশেষ করে স্বামীজীর, “বল ভারতবাসী- ভারতবাসী আমার ভাই, বল মূর্খ ভারতবাসী, দরিদ্র ভারতবাসী, ব্রাহ্মণ ভারতবাসী, চণ্ডাল ভারতবাসী আমার ভাই-তুমিও একটিমাত্র বস্ত্রাবৃত হইয়া স্বদর্পে ডাকিয়া বল ভারতবাসী আমার ভাই, ভারতের দেবদেবী আমার ঈশ্বর, ভারতের সমাজ আমার শিশুশয্যা, আমার বার্দ্ধক্যের বারাণসী, আর বল দিনরাত হে গৌরীনাথ, হে জগদম্বে আমার কাপুরুষতা, দুর্বলতা দূর কর আমায় মানুষ কর” প্রভৃতি কথাগুলি পড়ে তিনি যে আদর্শ খুঁজতেছিলেন, যেন ঠিক তা পেয়ে গেলেন। এই সম্বন্ধে নেতাজী বলছেন, “বিবেকানন্দের আদর্শকে যে সময়ে জীবনে গ্রহণ করলাম তখন আমার বয়স বছর পনেরও হবে কি না সন্দেহ। বিবেকানন্দের প্রভাব আমার জীবনে আমূল পরিবর্তন এনে দিল। চেহারায় এবং ব্যক্তিত্বে আমার কাছে বিবেকানন্দ ছিলেন আদর্শ পুরুষ। তাঁর মধ্যে আমার মনের অসংখ্য জিজ্ঞাসার সহজ সমাধান খুঁজে পেয়েছিলাম।”
আমরা সকলেই জানি, নেতাজী অনেক মেধাবী ছিলেন । কিন্তু বাস্তব জীবনে তিনি শুধু মেধাবী বা ভাল ছাত্র নন, মানসিকতার দিক থেকেও ছিলেন অনেক আলাদা, অনেক মহান । প্রবেশিকা পরীক্ষার আগে সকলে মনে করেছিল নেতাজী একটি বিশেষ স্থান অধিকার করবেন। কিন্তু পরীক্ষা নিকটবর্তী দেখেও তার পড়াশুনায় গাফিলতি দেখে সকলেই নিরুৎসাহী হয়ে গেলেন। সুভাষচন্দ্র তখন শ্রীরামকৃষ্ণের বাণী- জীব শিব এবং স্বামী বিবেকানন্দের বাণী – সেবা ধর্মকেই তার জীবনের সার বলে গ্রহণ করেছেন। পড়াশুনা তার কাছে তুচ্ছ।কিন্তু তা সত্ত্বেও ১৯১৩ সালে নেতাজী প্রবেশিকা পরীক্ষা দিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। সকলে তার রেজাল্ট দেখে অবাক হলেন। ভাল রেজাল্ট করার কারণে তিনি কুড়ি টাকা বৃত্তি পান। এই বৃত্তির টাকা তিনি দীন দুঃখীর সেবায় দান করেন।
এ প্রসঙ্গে একটি গল্প আছে । জানা যায়, প্রবেশিকা পরীক্ষার পর নেতাজী তার মাকে একখানি পত্র লিখেছিলেন। সেই পত্র্রের শেষাংশটি উল্লেখ করছি। – “পড়াশুনা করে যদি কেহ প্রকৃত জ্ঞান না লাভ করিতে পারে- তবে সে শিক্ষাকে আমি ঘৃণা করি। তাহা অপেক্ষা মূর্খ থাকা কি ভাল নয়? চরিত্র গঠনই ছাত্রের প্রধান কর্তব্য- বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা চরিত্র গঠনকে সাহায্য করে- আর কার কিরূপ উন্নত চরিত্র তাহা কার্যেই বুঝিতে পারা যায়। কার্যই জ্ঞানের পরিচায়ক। বই পড়া বিদ্যাকে আমি সর্বান্তকরণে ঘৃণা করি। আমি চাই চরিত্র-জ্ঞান-কার্য। এই চরিত্রের ভিতরে সবই যায়- ভগবদ্ভক্তি, স্বদেশপ্রেম, ভগবানের জন্য তীব্র ব্যাকুলতা সবই যায়। বই পড়া বিদ্যা ত তুচ্ছ সামান্য জিনিস- কিন্তু হায় কত লোকে তাহা লইয়া কত অহঙ্কার করে।”