আসল সোনা কিভাবে চিনবেন তা নিয়ে বিভ্রান্তি অনেক মানুষের মধ্যেই আছে, তাই খাঁটি সোনা কিভাবে চিনবেন তাই নিয়ে আজ আলোচনা করা হবে আজকের প্রতিবেদন এ।
একটি হলুদ বর্ণের ধাতু সোনা। বহু প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ এই ধাতুর সাথে পরিচিত ছিল। এ ধাতুর মূল বৈশিষ্ট্য অপরিবর্তনীয়। এছাড়া চকচকে বর্ণ, বিনিময়ের সহজ মাধ্যম, কাঠামোর স্থায়ীত্বের কারণে এটি অতি মূল্যবান ধাতু হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আসছে সেই প্রাচীনকাল থেকেই। প্রাচীনকাল থেকে বিভিন্ন ধরণের অলাঙ্কার তৈরি করা হয় সোনা থেকে। জার্মানির বিখ্যাত সমাজতত্ত্ববিদ কার্ল মার্ক্স সোনাকে মানুষের আবিস্কৃত প্রথম ধাতু হিসাবে চিহ্নিত করেন। সোনাকে অর্থের প্রধান মানদন্ড হিসাবে ধরা হয়। এই সোনা নিয়ে প্রাচীনকাল থেকে জাতিতে জাতিতে যুদ্ধ হয়েছে, প্রাণ হারিয়েছে অগণিত মানুষ। আবার সোনার মালিক হয়েও কেউ শান্তি পায়নি।
এই সোনাকে নিয়ে বিশেষ করে মহিলাদের একটি বড়াই থাকে আবারই সোনা হয় অসময়ের জীবন রক্ষাকারী আবার কখনও জীবন ঘাতিনী। সেই সোনা কেনাটাও সহজ সাধ্য নয়। সোনা কেনা স্বাভাবিক ভাবে আমাদের সাধ্যের বাইরে। সেই সোনা কিনতে গিয়ে যদি হয় নকল সোনা। সোনাকে ধরা হয় শুভর প্রতীক। যে কোন শুভ কাজে পুত্রবধুর মুখ দেখা, ছেলে মেয়ের প্রথম মুখ দেখা সোনায় হয়। আবার সেই সোনা অনেক সময় হতে পারে বিয়ে বাড়িতে মেয়ের বাবার গলার কাটা। সোনার গয়নার জন্য বিয়ে না করেই চলে যায় বিয়ে করতে আসা যুবক।
সে সোনা যে কথাই থাকনা কেন সোনা কেনার আগে সোনা চেনা দরকার। না হলে ঠকার কোন শেষ নেই । সোনা যারা তৈরি করে তাদের সম্পর্কে বলা হয় তারা মায়ের কানের দূল থেকেও সোনা চুরি করে। সোনা চোরাচালান তা তো নিয়মিত খবরের শিরোনাম। বলা হয় বাংলাদেশের সোনার খনি না থাকলেও তিনটি সোনার খনি আছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং সিলেটে তিনটি বিমানবন্দর সোনার খনি হিসাবে পরিচিত হয়ে উঠছে! সবচেয়ে বড় সোনার খনি হিসাবে পরিচিত হলো রাজধানীর বিমানবন্দরটি। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে এ খাত থেকে বাংলাদেশ ৬৭২ মার্কিন ডলার রপ্তানি আয় করেছে। বাংলাদেশে বছরে ২০ থেকে ৪০ টন সোনা লাগে।
একই জায়গায় ভারত সোনার ক্ষেত্রে প্রতি বছরে প্রায় 800-900 টন খরচ করে বিশ্বের সবথেকে বড় গ্রাহক হওয়া সত্ত্বেও, ভারত নিজে খুব সামান্য পরিমাণ সোনা খনন করে৷ ভারতের শেষ সোনার খনি কর্ণাটকের হট্টি সোনার খনি 1902 সালে উৎপাদন শুরু করে 2015 সালে 45,000 আউন্স হলুদ ধাতু উৎপাদন করে
সোনার আলোচনা ছেড়ে এবার জানার চেষ্টা করি সোনা চেনার সহজ উপায় কি হতে পারে অথবা খাঁটি সোনা কিভাবে চিনবেন?
খাঁটি সোনা কিভাবে চিনবেন, আসুন জেনে নিই ?
২৪ ক্যারেটের সোনাঃ
সোনা হয় মূলত ২৪ ক্যারেটের। তবে ২৪ ক্যারেটের সোনা দিয়ে গয়না তৈরি হয় না। কারণ সেটা এত নরম হয় যে, গয়না তৈরি করা সম্ভব হয় না। গয়না তৈরির জন্য মূলত ২২ ক্যারেটের সোনা ব্যবহার করা হয়। যার মধ্যে ৯১.৬৬ শতাংশ সোনা থাকে।
সোনায় লোহা মেশানোঃ
সোনার সাথে লোহা কথাটা শুনলেই কেমন যেন অস্বাভাবিক মনে হয়। আর এই অস্বাভাবিক কাজই সোনার ব্যবসায়ী করে থাকে। সোনায় যদি লোহা মেশানো থাকে, তা হলে চুম্বক ধরলেই সেটা টেনে নেবে। সোনায় লোহা মোশানো আছে কি না, তা চুম্বক ব্যবহার করে অবশ্যই পরখ করে নিন।
রাসায়নিক ও এসিড দ্বারা খাঁটি সোনা কিভাবে চিনবেনঃ
সোনা পরীক্ষা করার জন্য বাজারে কিছু রাসায়নিক এবং এসিড আছে যেগুলো ব্যবহার করে সোনার গুণগত মান যাচাই করা সম্ভব। ওই রাসায়নিক বা এসিড খাঁটি সোনার সংস্পর্শে এলে কোনো রকম বিক্রিয়া হয় না।
সাদা চিনেমাটির প্লেট খাঁটি সোনা কিভাবে চিনবেনঃ
সোনা যাচাইয়ের জন্য এটি একটি ভিন্ন টেকনিক। সাদা চিনেমাটির একটা প্লেটের সাহায্যে আপনি সোনা যাচাই করতে পারেন। সোনার গয়না চিনেমাটির প্লেটে ঘষে দেখুন। যদি থালার ওপর কালো দাগ পড়ে তা হলে বুঝতে হবে সোনা নকল। আর যদি হালকা সোনালি রং পড়ে তা হলে বুঝতে হবে সেটা আসল।
দুই গ্লাস পানিঃ
সোনার দোকানে আপনি তো চিনামাটির প্লেট বা রাসায়নিক এসিড নিয়ে যাবেন না তাহলে কি করবেন। দোকানে ঢুকে দোকানদারকে পানি খাওয়াতে বলুন। তবে এক গ্লাস নয় সাথের বান্ধবী বা স্ত্রীর জন্যও এক গ্লাস দিতে বলুন। আর যদি কাউকে অন্ধকারে উপহার দিতে হয় তাহলে কি করবেন দোকানদারকে বলুন দুই গ্লাস পানি খাওয়াতে। একটা গভীর পাত্রের মধ্যে দুই গ্লাস পানি নিন। তাতে কিনে আনা সোনার গয়না ফেলে দেখুন সেটা ভাসছে কি না। যদি ভাসে তা হলে বুঝতে হবে সেটা নকল।
কামড় দিয়ে খাঁটি সোনা কিভাবে চিনবেনঃ
এ পরীক্ষাটি চালানর আগে নিজে পরীক্ষা করুন না হলে আবার দাগ ফেলে দেওয়ার জন্য দোকানদার জরিমানাও করতে পারে। হালকা কামড় দিয়ে ধরে রাখুন সোনা। যদি আসল হয় তা হলে সোনার ওপর কামড়ানোর হালকা দাগ পড়বে।
ঘামের স্পর্শে আনাঃ
ঘামের সংস্পর্শে এলেও আসল সোনাতে কখনো ঘামের গন্ধ ধরে না। যদি ঘামের গন্ধ ধরে তা হলে বুঝতে হবে এটি খাঁটি সোনা নয়।
ভিনেগার দ্বারা খাঁটি সোনা কিভাবে চিনবেনঃ
ভিনেগার দিয়েও সোনা পরীক্ষা করা সম্ভব। একটি গ্লাসে কিছু পরিমাণ হোয়াইট ভিনেগার নিয়ে তারমধ্যে গহনাটি ১৫ মিনিট ডুবিয়ে রাখুন। তারপর গ্লাস থেকে গহনাটি বের করে নিন। খাটি স্বর্ণ হলে সেটা আগের মতোই চমকাবে আর নকল হলে উজ্জ্বল্য হারাবে।
BIS চিহ্ন দেখে খাঁটি সোনা কিভাবে চিনবেনঃ
BIS চিহ্ন দেখে সোনা কিনুন – সাধারণত, সোনা কেনার আগে হলমার্ক দেখেই মানুষ কেনেন। এটাই নিয়ম খাঁটি সোনা চেনার ক্ষেত্রে। কিন্তু এছাড়াও BIS চিহ্ন দেখে সোনা কিনুন। তাতে আপনি নিশ্চিত থাকবেন যে, আপনার সোনা সত্যিই খাঁটি।
ফ্লুরোসেন্স মেশিনে এক্স রে করাঃ
ফ্লুরোসেন্স মেশিনে এক্স রে করিয়ে নিন। যদিও এই পদ্ধতিতে সোনা যাচাই করে নেওয়াটা একটু কঠিন। কারণ সব জায়গাতে সচরাচর এমন সূযোগ আপনি নাও পেতে পারেন।
হলমার্ক চিহ্ন দেখে খাঁটি সোনা কিভাবে চিনবেনঃ
হলমার্ক চিহ্ন অবশ্যই দেখে কিনবেন। এই সতর্কবার্তা বহুবার শুনেছেন নিশ্চই। একদম ঠিক। হলমার্ক সোনার চরিত্র বুঝতে সাহয্য করবে আপনাকে। তবে সতর্ক থাকতে হবে ব্যবসায়ীরা এ চিহ্ন ডুপ্লিকেট করতে পারে।
সোনার এত চাহিদা সেই সোনা পড়া নিয়ে বিজ্ঞান কিছু না বললেও জ্যোতিষশাস্ত্র মনে করে সোনা ভাগ্যকেও প্রভাবিত করে। এবার জ্যোতিশাস্ত্রে সোনার উপকারিতা দেখিঃ
অকাল বার্ধক্য রোধ করেঃ
শরীরের মধ্যে থাকা একটি প্রোটিন উপাদান, কোলাজেন, আপনার ত্বকের নমনীয়তা রক্ষা করে৷ এই কোলাজেন বয়সের সাথে কমতে থাকে৷ সোনা এই কোলাজেনের স্তর ধরে রাখতে সাহায্য করে এং আপনার ত্বককে সতেজ রাখে, তাই আপনার ত্বক ঝুলে পরেনা-মানে অকাল বার্ধক্য আসেনা৷
বলিরেখা থেকে মুক্তিঃ
সোনা আপনার ত্বকের মৌলিক কোষগুলিকে কার্যকর করতে সাহায্য করে যা নমনীয়তা বৃদ্ধি করে৷ এর ফলে বলিরেখা, দাগ, ছোপ, এবং সূক্ষ্ম রেখা কমতে শুরু করে এবং আপনার ত্বক পরিষ্কার হয়৷
ত্বকের প্রদাহ কমায়ঃ
বিশ্বাস করা হয় সোনার প্রদাহ-বিরোধী এবং ব্যাকটেরিয়া-বিরোধী বৈশিষ্ট্য আছে৷ এটি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসাবেও কাজ করে এবং ত্বকের কোষে অক্সিজেনের সরবরাহ বাড়ায়৷ যার ফলে, এটি ব্রণ এবং অন্যান্য ত্বকীয় অ্যালার্জি কমাতে সাহায্য করে৷
রৌদ্রে হওয়া ক্ষতির ব্যবস্থা নেয়ঃ
সরাসরি সূর্যের নিচে এবং দূষণের মধ্যে আমাদের ক্রমাগত থাকতে হয় বলে,মেলানিনের উৎপাদন বৃদ্ধি হয়-মেলানিন হল এমন একটি রঞ্জক পদার্থ যা ত্বককে আরো বেশি কালো করে দেয়৷ সোনা এই মেলানিনের পরিমাণ কমাতে সাহায্য করে যার ফলে সূর্যের থেকে হওয়া ক্ষতি নিয়ন্ত্রিত হয়৷1 2 প্রাকৃতিক চমক আনার জন্য এবং ত্বকের উজ্জ্বলতা তৈরি করার জন্য সেলুনে গোল্ড ফেসিয়াল খুবই জনপ্রিয়ভাবে ব্যবহৃত হয়, এটি ত্বককে আর্দ্র এবং স্বনিত করে৷
শরীরের উপর খারাপ শক্তির প্রভাব কম পরেঃ
এমনটা বিশ্বাস করা হয় যে সোনার গয়না পরলে শরীরে উপস্থিত ব্ল্যাক এনার্জি দূরে পালাতে শুরু করে। ফলে শরীরের কোনও ধরনের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা যায় কমে।
অফুরন্ত সুখ–শান্তির সন্ধান মেলেঃ
নানাবিধ ধাতুর প্রভাব শরীরের উপর কেমনভাবে পরে, সে বিষয় যারা গবেষণা করেন, তাদের মতে সোনার গয়না পরলে আমাদের চারিপাশে পজেটিভ শক্তির মাত্রা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে, যার প্রভাবে গৃহস্থে যেমন সুখ-শান্তির ছোঁয়া লাগে, তেমনি এমন স্ট্রেসফুল পরিবেশেও মানসিক শান্তি বজায় থাকে।
কু–দৃষ্টির প্রভাব থেকে মুক্তি মেলেঃ
আজকের প্রতিযোগীতায় জীবনে সবাই যেখানে সামনের জনকে মেরে আগে এগিয়ে চেষ্টায় লেগে রয়েছে, সেখানে ইর্ষান্বিত হয়ে কেউ যে আপনার ক্ষতি করার চেষ্টায়
অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটেঃ
এমনটা বিশ্বাস করা হয় যে সোনার গয়না পরলে আমাদের চারিপাশে পজেটিভ শক্তির মাত্রা বাড়তে শুরু করে, যার প্রভাবে অল্প সময়ে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির স্বাদ পেতে সময় লাগে না। সেই সঙ্গে কোনও ধরনের অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখিন হওয়ার আশঙ্কাও হ্রাস পায়।
যে কোনও ধরনের সমস্যার খপ্পর থেকে মুক্তি মেলেঃ
বিশেষজ্ঞদের মতে অনামিকা বা রিং ফিঙ্গারে সোনার আংটি পরলে জীবন পথে চলতে চলতে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠা যে কোনও সমস্যার হাত থেকে মুক্তি মেলে। সেই সঙ্গে কোনও ধরনের বিপদ ঘটার সম্ভাবনাও যায় কমে। (খাঁটি সোনা কিভাবে চিনবেন প্রতিবেদন এর উপরের দিকে পড়ুন)
মহিলারা সোনার অলঙ্কার বেশি পড়লেও অনেক সময় পুরুষদেরও সোনা ব্যবহার করতে দেখা যায়। তবে মহিলারা তার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় সোনা ব্যবহার করলেও পায়ের নুপুর হিসাবে সোনাকে ব্যবহার করে না। এর পিছনে কারন সোনা হলো সোনা হল লক্ষ্মীর প্রতীক। লক্ষ্মী রুপে তাকে পূজা করা হয়। তাই এর একটি একটি আলাদা ধার্মিক মাহাত্ম্য আছে। তাই একে পায়ে পড়া ঠিক নয় বলে অনেকেই মনে করেন। তাই বেশিরভাগ সময়ে রুপোর নূপুরই পড়তে দেখা যায় বাঙালি মেয়েদের।
সোনা আমাদের এতই পছন্দ গান কবিতার পাশাপাশি নিজের ছেলে মেয়ের নামও সোনা রাখা হয়। সোনা প্রবাদেও জায়গা দখল করেছে সোনার সাথে হরিণ মিশে অসম্ভবের কথা বলা হয়েছে। কবিগুরুর ‘আমার সোনার ধান’, ‘যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী’ থেকে আমার সোনার বাংলা। নিজের মা, মাতৃভাষা সর্বত্রই ভালোর ক্ষেত্রে সোনার ব্যবহার হয়েছে।(খাঁটি সোনা কিভাবে চিনবেন প্রতিবেদন এর উপরের দিকে পড়ুন)
অনেক বাঙ্গালীদের মধ্যে প্রচলিত আছে অক্ষয় তৃতীয়ার দিনে সোনা কেনা ভাল। সোনার পাথর বাটি না হলেও সোনা যে সভ্যতার শুরু থেকে এখনও আছে বহাল তবিয়তে তার আর বলার কি আছে?