প্রায় দু’শো বছর ইংরেজ আধিপত্যের শাসনে থেকে অবশেষে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই আগস্ট পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন করে ঐতিহাসিক দেশ ভারতবর্ষ। মূলত শান্তিপূর্ণ হস্তান্তরের মাধ্যমে ভারত স্বাধীন হলেও এর পেছনে ছিলো বহু নির্মম, রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের ইতিহাস!
ঔপনিবেশিক শক্তি প্রতিষ্ঠা :
১৪৯৮ খ্রিস্টাব্দে পর্তুগীজ নাবিক ভাস্কো-দা-গামা ভারতের কালিকট বন্দরে আসেন। সেই সময় কালিকটের রাজা ছিলেন জামেরিন। এরপর আসেন জন ক্যাব্রাল, তিনিই ভারতে প্রথম পর্তুগীজ কুঠি স্থাপন করেন। এরপর পর্তুগীজ’দের দেখাদেখি ক্রমে অন্যান্য বহু ঔপনিবেশিক শক্তি ভারতে প্রবেশ করতে শুরু করে, যার মধ্যে ছিলো ওলন্দাজ, দিনেমার, ফরাসী এবং ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। অন্যান্য ঔপনিবেশিক শক্তিগুলি এক এক করে ফিরে গেলেও ফরাসী এবং ব্রিটিশ শক্তি ভারত থেকে তাদের ঘাঁটি সরায়নি। ফরাসী ঔপনিবেশিক ফ্রান্সিস ডুপ্লে ভারতে প্রথম সাম্রাজ্য স্থাপনের স্বপ্ন দেখেন, আর তাদের একমাত্র প্রতিপক্ষ ছিল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অর্থাৎ ইংরেজ’রা। ফরাসী’রা তাদের কুঠি স্থাপন করেছিলো চন্দননগরে এবং ইংরেজ’দের কুঠি ছিলো কলকাতা’য়। কিন্তু অবশেষে ইংরেজ শক্তির শক্তি এবং কূটনীতির সামনে টিকতে পারেনি ফরাসী শক্তি, তাই তারা ভারতে তাদের সাম্রাজ্য স্থাপনের স্বপ্ন ছেড়ে দেয়।
ইংরেজ শক্তি স্থাপন এবং ভারতীয়দের বিদ্রোহ :
১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশির যুদ্ধে জয়লাভের মধ্য দিয়ে ভারতে ইংরেজ শাসনের প্রতিষ্ঠা হলেও ১৭৬৪ খ্রিস্টাব্দে বক্সারের যুদ্ধে জয়লাভ করার পর চূড়ান্তভাবে ভারতে নিজেদের আধিপত্য স্থাপন করতে থাকে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। এরপর থেকে প্রায় ড’শো বছর পর্যন্ত ভারতবর্ষে নিজেদের আধিপত্য কায়েম রেখেছিলো ইংরেজ শক্তি।
ধীরে ধীরে ইংরেজ শক্তির নির্মম শাসন ও শোষণ নীতিতে অতিষ্ট হয়ে ওঠে ভারতের সাধারণ নাগরিকগণ। আর এই ক্ষোভের প্রকাশ হতে থাকে একের পর এক বহু আঞ্চলিক বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে। এর মধ্যে ফরাজী, ওয়াহাবি আন্দোলন, সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, কৈবর্ত বিদ্রোহ, সাঁওতাল বিদ্রোহ ইত্যাদি এবং আরও একাধিক বিদ্রোহের নাম উল্লেখযোগ্য। এই সকল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আঞ্চলিক বিদ্রোহ’গুলি অবশেষে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে মহাবিদ্রোহের রূপ নিয়ে আত্মপ্রকাশ ঘটায়। মহাবিদ্রোহের পরে ভারতের শাসনভার গ্রহণ করেন ইংল্যান্ড এর মহারাণী ভিক্টোরিয়া।
এরপর ভারতের বৈপ্লবিক আন্দোলনে যুগান্তর ঘটতে দেখা যায়। এই সময় ভারতের বিভিন্ন স্থানে ছোট ছোট গুপ্ত বিপ্লবী সংস্থা গড়ে ওঠে, আর এই সব সংস্থায় অংশগ্রহণ করতে থাকে ভারতের বহু শিক্ষিত যুবক। আঞ্চলিক বিদ্রোহের পরিবর্তে একের পর এক ইংরেজ’দের ঊর্ধ্বতন আধিকারিকদের’কে হত্যা করার মাধ্যমে তাদের মনে ভীতি সঞ্চার করতে থাকে এরা। এঁদের মধ্যে ক্ষুদিরাম বসু, প্রফুল্ল চাকি, চন্দ্রশেখর আজাদ, ভগত সিং, বিনয়-বাদল-দীনেশ, বাঘাযতীন, রাজগুরু, সুখদেব প্রভৃতি নাম উল্লেখযোগ্য।
জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা :
এরপর ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে গড়ে ওঠে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস দল। ১৮৮৫ সালের ২৮-৩০শে ডিসেম্বর বোম্বাই এর ‘গোকুলদাস তেজপাল সংস্কৃত কলেজ’-এ কলকাতার বিশিষ্ট আইনজীবী উমেশচন্দ্র ব্যানার্জি’র সভাপতিত্বে জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশন বসে।
১৮৮৫ থেকে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কংগ্রেসের নরমপন্থী যুগ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই সময় তেমন বৃহৎ কোনও আন্দোলন ঘটেনি। ইংরেজ শক্তির সাথে আপোষের মধ্য দিয়েই ভারতের স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব, এমনই ধারণা ছিলো এদের। কংগ্রেসের কিছু বিশিষ্ট নরমপন্থী নেতা ছিলেন দাদাভাই নৌরজী, কে. টি. তালাং, গোখলে, ফিরোজশাহ মেহতা, এ. এম. ধরমজী, বদরুদ্দীন তায়েবজি, উমেশচন্দ্র ব্যানার্জি, আনন্দ চারলু, সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, রহমতউল্লা সাহানি, শ্রীশঙ্করণ আইয়ার, আনন্দমোহন বসু, দিনশা ওয়াচা, রাসবিহারী ঘোষ, লালমোহন ঘোষ, হেনরি কটন প্রমুখ।
সেই সময় জাতীয় কংরেসে এক নতুন গোল বাঁধল। দলের মধ্যে একদল নিজেদেরকে চরমপন্থী হিসাবে দাবি করে বসল; যাদের কথা হল আপোষ নয়, ছিনিয়ে নিতে হবে স্বাধীনতা। এরপর ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেসের সুরাট অধিবেশনে এই মতভেদ চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছালে অবশেষে জাতীয় কংগ্রেস দু’টি ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়, যথা – নরমপন্থী ও চরমপন্থী। উল্লেখ্য, ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে প্রথম ‘স্বরাজ’ কথাটি ব্যবহার করা হয়।
জাতীয় কংগ্রেসের ১৯১৮ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত সময়কালকে বলা হয় ‘গান্ধী যুগ’। এই সময় গান্ধীজির নেতৃত্বে জাতীয় কংগ্রেস দল ইংরেজদের বিরুদ্ধে একাধিক আন্দোলন করে। এর মধ্যে ‘আইন অমান্য আন্দোলন’, ‘অসহযোগ আন্দোলন’ এগুলি বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
সুভাষচন্দ্র বসু ও আজাদ-হিন্দ-ফৌজ :
১৯২০ খ্রিস্টাব্দের পর ভারতের জাতীয় কংগ্রেসে সুভাষচন্দ্র বসু যোগদান করেন। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে কলকাতা কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসাবে নিযুক্ত করা হয়।
পরপর দু’বার ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নিরবাচিত হয়েছিলেন সুভাষচন্দ্র। একটি ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে হরিপুরা কংগ্রেস অধিবেশনে এবং অপরটি ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ত্রিপুরি অধিবেশনে; কিন্তু গান্ধীজী’র বিরাগভাজন হওয়াই ত্রিপুরি অধিবেশনে সভাপতির পদে ইস্তফা দেন তিনি। এরপর ১৯৩৯ সালে জাতীয় কংগ্রেস থেকে আলাদা হয়ে গিয়ে সুভাষচন্দ্র ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ নামে একটি নতুন দল গড়ে তোলেন।
এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে জার্মানি’র হাতে বন্দী ভারতীয় সেনা নিয়ে সুভাষ গড়ে তোলেন ‘আজাদ-হিন্দ-বাহিনী’। এটি মূলত গড়ে উঠেছিল জাতীয়তাবাদী নেতা রাসবিহারী বসুর হাতে, ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে রাসবিহারী বসু সেনাবাহিনীর দায়িত্ব সুভাষ চন্দ্র বসুকে হস্তান্তর করেণ। এই সময় সুভাষ ভারতের বাইরে বহু জায়গায় আজাদ-হিন্দ-বাহিনী’র সাহায্যের জন্য অনুরোধ চেয়ে বক্তৃতা দিতেন এবং বলতেন, “তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেবো।”
সুভাষচন্দ্র ‘আজাদ-হিন্দ-বাহিনী’র সম্পূর্ণ নিজস্ব একটি সরকার প্রতিষ্ঠা করেন। অক্ষ শক্তির ৯টি দেশ এই সরকারকে স্বীকৃতি দান করেছিলো। এরপর সুভাষ ‘আজাদ-হিন্দ-বাহিনী’র সেনাবাহিনীর উদ্দেশ্যে “দিল্লী চলো” ধ্বনি দেন এবং ভারত থেকে ইংরেজ শক্তিকে বিতাড়িত করতে বদ্ধপরিকর হন।
‘আজাদ-হিন্দ-ফৌজ’ মূলত জাপান থেকে আসা সাহায্যে ভর করে গড়ে উঠেছিলো। সুভাষচন্দ্র অবশ্য আশা করেছিলেন, ব্রিটিশদের উপর ‘আজাদ-হিন্দ-ফৌজ’-র হামলার খবর শুনে বিপুল সংখ্যক সৈন্য ভারতীয় সেনাবাহিনী থেকে এতে যোগ দেবে। কিন্তু তেমনটা ঘটলনা, বরং ভারতীয়রা ‘আজাদ-হিন্দ-ফৌজ’ এর সরকারকে সমর্থন করেনি।
অপরদিকে যুদ্ধ পরিস্থিতির অবনতির কারণে জাপান তার সৈন্যদের আইএনএ থেকে সরিয়ে নিতে থাকে এবং পাশাপাশি জাপান থেকে অর্থের সরবরাহ কমে যায়। অবশেষে, জাপানের আত্মসমর্পণের সঙ্গে সঙ্গে ‘আজাদ-হিন্দ-ফৌজ’ নিজেদের অস্ত্র ত্যাগ করতে বাধ্য হয়।
উল্লেখ্য, ২০ বছরে মোট ১১ বার গ্রেফতার হয়েছিলেন সুভাষচন্দ্র।
ভারত-পাকিস্তান বিভাজন এবং ভারতের স্বাধীনতা দান :
ভারতীয়’দের একের পর এক আন্দোলনের ফলে ব্রিটিশ সরকার নাজেহাল হয়ে গিয়েছিল। তাছাড়া ১৯৪৬ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইংল্যান্ড এর আর্থিক কাঠামো খুবই দুর্বল হয়ে পড়েছিলো। এমতাবস্থায় ভারতকে স্বাধীন করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ইংরেজ সরকার। ঘোষণা করা হয়, ১৯৪৮ সালের ৩০শে জুন তারিখের মধ্যে ভারতবর্ষ’কে পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান করা হবে।
কিন্তু এই সময় ভারতের জাতীয় কংগ্রেস এবং মুসলিম লিগ-এর মধ্যে বিবাদ জোড়ালো হয়ে উঠলে ভারতকে স্বাধীন করার সময় এগিয়ে নিয়ে আসেন লর্ড মাউন্টব্যাটেন।
১৯৪৭ সালের ৩শরা জুন ব্রিটিশ সরকার ভারতকে দ্বিখণ্ডিত করার সিদ্ধান্ত অনুমোদন করে ঘোষণা করে, নবগঠিত দুই রাষ্ট্রকে অধিরাজ্য মর্যাদা দেওয়া হবে এবং ব্রিটিশ কমনওয়েলথ থেকে পৃথক হওয়ার পূর্ণ ক্ষমতা দু’টি রাষ্ট্রেরই থাকবে। ঘোষণা অনুযায়ী ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের উত্তর-পশ্চিম অংশ পৃথক হয়ে ‘পশ্চিম পাকিস্তান’ এবং বঙ্গের পূর্ব অংশ পৃথক হয়ে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ হিসাবে গড়ে উঠবে। ভারত বিভাজনের এই খবরে এই সময় সারা দেশ জুড়ে চলতে থাকে অজস্র রক্তপাত, বিশেষ করে বঙ্গ এবং পাঞ্জাব প্রদেশে হিন্দু-মুসলমান পরস্পরের শত্রু হয়ে ওঠে। লাখো লাখো মানুষের প্রাণ যায় এই দাঙ্গা’য়।
অবশেষে যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টে পাস হওয়া ভারতীয় স্বাধীনতা আইন অনুসারে ব্রিটিশ ভারত ভারত ও পাকিস্তান নামক দু’টি স্বাধীন অধিরাজ্যে বিভাজিত হয়। এই আইন কার্যকর হয় ১৯৪৭ সালের ১৪ অগস্ট এবং সেই সঙ্গে নবগঠিত দুই রাষ্ট্রের নিজ নিজ গণপরিষদের উপর সম্পূর্ণ আইনবিভাগীয় কর্তৃত্ব অনুমোদিত হয়। এরপর ১৫ই আগস্ট তারিখে প্রথম স্বাধীন ভারতবর্ষের মাটিতে ত্রিরঞ্জিত জাতীয় পতাকা তোলেন প্রধানমন্ত্রী জওহর লাল নেহেরু।