বাঙ্গালীর পাতে ঝালে-ঝোলে-অম্বলে জায়গা করে নিয়েছে ইলিশ, ভেটকি, পারসে, ভোলা সহ নানারকম নোনা ও মিঠে জলের মাছ। খাদ্যগুন এবং পুষ্টির নিরিখে মাছ অন্য প্রাণীজ খাদ্যের তুলনায় অনেক এগিয়ে। এহেন পুষ্টিযুক্ত এবং সুস্বাদু খাবার রান্না করার সময় খেয়াল রাখা উচিৎ যাতে এর স্বাদ ভালো থাকবে এবং পুষ্টিগুন বজায় থাকবে।(Fish Nutrition Chart – Types Of Fish In India To Eat)

 

তবে বাজারে সকলেই কম বেশী যাই। কিন্তু বাজারে গেলেই যে ভালো এবং টাটকা মাছ চেনার ক্ষমতা থাকবে তা তো নয়। সুতরাং, পুষ্টিগুন বজায় রাখতে গেলে প্রথমেই দরকার সঠিক ভাবে টাটকা মাছ নির্বাচন। মোটামুটি ভাবে টাটকা মাছ চেনার উপায় হল এর চোখ। চারামাছ বা সামুদ্রিক তৈলাক্ত মাছ যাই হোক না কেন টাটকা মাছের চোখ সবসময় উজ্জ্বল থাকবে। এছাড়া দেখতে হবে মাছের গায়ে পিচ্ছিল ভাব আছে কিনা। টাটকা মাছে একধরনের পিচ্ছিল লালা থাকে। মাছ বাসি হয়ে গেলে এইরকম পিচ্ছিল ভাব দেখা যায়না। এছাড়াও দেখতে হবে আঁশযুক্ত মাছ হলে তা শক্তভাবে আটকানো আছে কিনা। এর পরেও মনে রাখতে হবে মাছকে জলে ফেললে যদি ডুবে যায় তাহলে সেই মাছটি টাটকা বলে ধরে নেওয়া যাবে।

 

বাজার থেকে মাছ বাড়িতে আনার পর পরিস্কার জলে ধুয়ে লবন-হলুদ মাখিয়ে রাখলে রান্নার সময় পর্যন্ত মাছ পুষ্টিগুন সম্পন্ন এবং জীবাণুমুক্ত থাকে। বাজারে চলতি মাছ ছাড়াও শুঁটকি মাছও ক্যালসিয়াম ও প্রোটিনের ভালো উৎস। অনেকেই শুঁটকি মাছ ভালো পছন্দ করেন। কিন্তু শুঁটকি মাছের তীব্র গন্ধের জন্য অনেক বাঙ্গালিই অনীহা দেখায় এই মাছের ব্যাপারে।

 

মাছের পুষ্টিগুন সম্পর্কে বলতে গেলে বলতে হয় এতে আছে প্রোটিন, ফ্যাট, পটাশিয়াম, ফসফরাস, ভিটামিন-ডি, ওমেগা-থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড প্রভৃতি।

 

Fish Nutrition Chart(Types Of Fish In India To Eat)

প্রথমেই আসি ওমেগা-থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিডের কথায়

মূলত, সামুদ্রিক মাছগুলিতে ওমেগা-থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড পাওয়া যায়। এই উপাদান মস্তিষ্কের কোষগুলির সুস্থতা বজায় রাখে। মানসিক শক্তি বাড়ায়। এছাড়া বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে মানুষের যে ভুলে যাবার প্রবনতা, সেটিকে রোধ করে। অ্যালঝাইমারস রোগের সম্ভাবনা হ্রাস করে ওমেগা-থ্রি- ফ্যাটি অ্যাসিড। এর আরও একটি ভালো গুন আছে, এটি রক্তকে পাতলা রাখে এবং রক্ত ধমনীতে রক্ত জমাট বাধার প্রবনতা রোধ করে। ফলে শরীরে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রনে থাকে ও হৃদরোগের, স্ট্রোকের সম্ভাবনা বা ঝুঁকি কমিয়ে দেয়।

 

প্রতি সপ্তাহে অন্তত দিন মাছকে খাদ্য তালিকায় রাখলে শিশুদের ক্ষেত্রে ব্রঙ্কিয়াল অ্যাজমা বা হাঁপানি হবেনা। বড়দের ক্ষেত্রে মুখগহ্বর, খাদ্যনালী, কোলন, ডিম্বাশয় ও স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি ৩০-৫০% কমে যায়। চোখের রেটিনাকে সুস্থ রাখে, বাতের ব্যাথায় রেহাই মেলে এছাড়াও অ্যান্টি থ্রম্বটিক থাকার কারণে রক্ত ধমনীকে খাদ্যের বিষক্রিয়া জনিত ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা করে। রক্তের ট্রাইগ্লিসারাইড ও কোলেস্টেরলের মাত্রা হ্রাস পায়, ফলে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কমে।

 

মাছের পুষ্টিগুন এককথায় বলে শেষ করা যায়না।নিয়মিত মাছ খেলে রক্তের শর্করার পরিমান হ্রাস পায়। গর্ভাবস্থায় মাছ খেলে প্রি-ম্যাচিওর শিশু জন্মানোর ঝুঁকি থাকেনা। দেহের অনাক্রম্যতা বজায় রাখায় মাছের ভূমিকা আছে। প্রাথমিক অবস্থায় কিডনির সমস্যা থেকে মুক্ত করে। এছাড়া ডিপ্রেশন ধারে কাছে ঘেঁসতে পারেনা।

 

যারা নিয়মিত মাছ খেতে অভ্যস্ত তারা নিশ্চয়ই আশান্বিত হচ্ছেন যে এককথায় বলতে গেলে মাছের উপকারিতার কথা বলে শেষ করা যাবেনা। তবে এতকিছুর পরেও সবচেয়ে হতাশাজনক বিষয়টি হল, পুষ্টি ও খাদ্যগুনের বিচারে মাছ যতই উপরের আসনে থাকুক না কেন, আমরা যেভাবে ছাঁকা তেলে ভেজে বিভিন্ন পদে উপাদেয় করে রান্না করি তাতে রান্নাটা মুখরোচক ও সুস্বাদু হলেও ওপরে বর্ণিত গুণাবলীর কোনও কিছুই আমাদের উপকারে লাগেনা বরং অপকার হয় অনেক।(Fish Nutrition Chart – Types Of Fish In India To Eat)

মাছ রান্না করার সময় কতগুলি বিষয় মাথায় রাখা উচিৎ

বেশি তাপমাত্রায় অর্থাৎ চড়া আঁচে অধিক সময় ধরে তেলে ভেজে রান্না করায় মাছের উপকারী অত্যাবশ্যক ফ্যাটি অ্যাসিডগুলির রাসায়নিক উপাদানের পরিবর্তন হয়। এছাড়া তেলের রাসায়নিক উপাদানের গঠনের পরিবর্তিত হয়ে বিভিন্ন ক্ষতিকর উপাদান তৈরি হয়, যা শরীরের পক্ষে একান্তই ক্ষতিকর এবং বহু জটিল রোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। উচ্চমাত্রার তাপে মাছের পেশীতে অবস্থিত মায়োসিন ও অ্যাক্টোমায়োসিন নষ্ট হয়। এগুলিই মাছের প্রোটিন।

 

তবে আশার কথা তৈলাক্ত মাছের ক্ষেত্রে এই আশঙ্কা একটু কম থাকে। ১০০ ডিগ্রি সেন্ট্রিগ্রেডের ওপরে তাপমাত্রা গলেই উৎপন্ন হতে থাকে এইচ সি এ এস এবং পি এইচ এস -এগুলি মূলত ক্যান্সার সৃষ্টিকারী পদার্থ। বোঝাই যাচ্ছে এই ধরনের সমূহ ক্ষয়ক্ষতির হার থেকে আমাদের শরীরকে বাঁচানোর প্রধানতম উপায় হচ্ছে কম তাপমাত্রায় রান্না করা। এছাড়া প্রত্যক্ষ তাপের পরিবর্তে পরোক্ষ তাপ প্রয়োগে রান্নার বিভিন্ন পদ্ধতি যেমন- বয়েলিং বা জলে মাছ সিদ্ধ করা, ভাপানো প্রভৃতির সাহায্যে মাছ রান্না করা।

 

বর্জন করা উচিৎ ছেঁকা তেলে ভালভাবে ভেজে রান্না করা, মাইক্রোওভেনে উচ্চতাপমাত্রায় রান্না, রোষ্টিং, গ্রিলিং সবকিছুই। পরোক্ষ তাপ প্রয়োগে রান্না মাছ থেকে পুষ্টিগুন ভালভাবে পাওয়া যায়। কিছু টিপস জানা থাকলে আপনার প্রিয় খাদ্যটির খাদ্যগুন সর্বাধিক সুসাস্থ্যের উপকারী করে তুলতে পারেন। তাহলে আসুন কিছু নিয়মকানুন জেনে নেওয়া যাক –

 

মাছের পেশীতন্তুগুলি তুলনামূলক ছোটো হবার কারণে, অল্প সময় ও কম তাপমাত্রাতে রান্না সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত হয়। তাই দরকারি মশলা ছাড়াও কারীপাতা, ধনেপাতা, তেজপাতা, পুদিনাপাতা ইত্যাদি সহযোগে জলে সিদ্ধ করে অথবা স্ফুটনাঙ্কের নিচের তাপমাত্রায় পোচিং করে রাঁধুন। পোচিং করার ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে পারেন মাছের স্টক অথবা পিঁয়াজ, রসুন ও অন্যান্য মশলা মিশ্রিত জল। এক্ষেত্রে ঢিমে  আঁচে তরলকে সেদ্ধ করে তার মধ্যে ম্যারিনেট করা মাছকে রেখে ততক্ষন রাঁধতে হবে, যতক্ষণ না মাছের স্বচ্ছপেশী সাদা মাংসল অংশে পরিনত হয়।

 

উপসংহারে বলা যেতে পারে, ছাঁকা তেলে মাছ ভেজে শুধুমাত্র মুখের স্বাদের কথা না ভেবে একই সাথে স্বাদ ও স্বাস্থ্যর খেয়াল করে রান্না করুন।

Payel Kumar is a News Writer at BongDunia. She has a little knowledge about journalism. She has worked with various news agencies in the previous years. She has done her graduation from West Bengal State University.

Leave A Reply