ফরিদপুরের বঙ্গ জংশন থেকে পায়রা বন্দর হয়ে বরিশাল হয়ে কুয়াকাটা পর্যন্ত নতুন রেললাইন নির্মাণের পরিকল্পনা করছে সরকার। এর মাধ্যমে ঢাকাসহ দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যে রেলপথের নতুন মেরুকরণ হবে। রেলপথের নির্মাণকাজ শুরুর আগে প্রায় সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু অর্থের অভাবে অবকাঠামোর কাজ শুরু হচ্ছে না।
এমন পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন চীন সফরে এই প্রকল্পে অর্থায়ন নিয়ে আলোচনা হতে পারে বলে রেল মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র জানিয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে এ প্রকল্প বাস্তবায়নে ঋণ দেবে চীন। রেলওয়ে সূত্র বলছে, চীন এই প্রকল্পে আগ্রহী। সম্প্রতি বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন প্রকল্পের সঠিক তথ্য পেতে বরিশাল সফর করেন।
ভাঙ্গা থেকে বরিশাল-পটুয়াখালী হয়ে কুয়াকাটা পর্যন্ত ২১৫ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪১ হাজার ৭৯৭ কোটি ৬১ লাখ টাকা। আর রেলপথ তৈরি হলে নির্মাণ ব্যয় ১ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। তবে বর্তমান প্রি-ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রপোজালে (পিডিপিপি) এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা নেই। রেলপথ মন্ত্রণালয় এই প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) মাধ্যমে ভারত, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপানসহ বিভিন্ন দেশ ও দাতা সংস্থাকে প্রস্তাব দেয়।
কিন্তু তহবিল এখনো নিশ্চিত করা হয়নি।
জানতে চাইলে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব হুমায়ুন কবির গতকাল কণ্ঠকে বলেন, রেলের আসন্ন প্রকল্পে এটিই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন চীন সফরে এটি অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। চীনের অর্থায়ন হতে পারে।
খোলা টেন্ডার হতে পারে না
প্রকল্পে অর্থায়নের ব্যবস্থা করা হলে দরপত্র আহ্বান, যাচাই-বাছাই, জমি অধিগ্রহণ, ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন এবং ভৌত অবকাঠামো তৈরির কাজ শুরু হবে। তবে দরপত্রের ধরন নির্ভর করে ঋণ চুক্তির ওপর। অর্থায়নকারী দেশ বা প্রতিষ্ঠান ঠিকাদার নির্ধারণ করলে কোনো উন্মুক্ত দরপত্র হবে না।
রেলওয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, অর্থায়নকারী দেশের চুক্তির ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। চীন তহবিল সরবরাহ করলে, চীনের মধ্যে খোলা দরপত্র আহ্বান করা যেতে পারে। সম্ভবত আবার নয়। সরাসরি চুক্তিও আলোচনা করা যেতে পারে। তবে আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে টেন্ডারের কাজ করা হবে। রেলওয়ের লক্ষ্য ছিল 2030 সালে ট্রেনে কুয়াকাটা পৌঁছানো যার নির্মাণ সময়কাল সাড়ে পাঁচ বছর।
পিডিপিপি নথি অনুযায়ী, ভাঙ্গা থেকে কুয়াকাটা পর্যন্ত রেলপথে কোনো লেভেল ক্রসিং থাকবে না। যেখানে সড়ক ও রেল যোগাযোগ থাকবে সেখানে বক্স কালভার্ট নির্মাণ করা হবে। এতে করে কম্পার্টমেন্টের ভেতরে ট্রেন চলবে এবং রাস্তার ট্রাফিক নিচের দিকে চলে যাবে। এই রেলপথ হবে ব্রডগেজ। ভবিষ্যতে ইলেকট্রিক ট্রেন চালানোর ব্যবস্থাও করবে। এই রুটে ট্রেন সর্বোচ্চ 160 কিলোমিটার প্রতি ঘন্টা গতিতে চলতে পারে।
ট্রেন কোন দিকে যাবে, কয়টি স্টেশনে যাবে?
ফরিদপুরের ভাঙ্গা থেকে ট্রেনটি গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, বরিশাল, ঝালকাঠি, বরগুনা, পটুয়াখালী হয়ে কুয়াকাটা যাবে। পায়রা বন্দরের আশেপাশে রেলওয়ে ইকোনমিক জোন তৈরি করতে চায় রেলমন্ত্রক। এছাড়াও এই প্রকল্পের আওতায় বরিশালে একটি রেলওয়ে মাল্টিমোডাল হাবও নির্মাণ করা হবে। এই দুই জায়গা মিলিয়ে এই রুটে মোট ১৯টি বড় রেলস্টেশন তৈরি করা হবে। পটুয়াখালী থেকে কুয়াকাটা পর্যন্ত ১৭ কিলোমিটার নিচু রেলপথ থাকবে।
যদিও ঢাকার সাথে সরাসরি ট্রেন সংযোগ স্থাপন করা হয়েছে, তবে ভাঙ্গা জংশন স্টেশনটিকে প্রকল্পের আওতায় স্টেশন নম্বর 1 হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এরপর মাদারীপুর, বরিশাল ও কুয়াকাটা তিনটি বড় স্টেশন হিসেবে বিবেচিত হবে। আরও 9টি মধ্যবর্তী স্টেশন থাকবে। সেগুলো হলো টেকেরহাট, গৌরনদী, বরিশাল বিমানবন্দর, বাকেরগঞ্জ, পটুয়াখালী, আমতলী, পায়রা বন্দর, পায়রা বন্দর ইয়ার্ড ও লেমুপাড়া। এর বাইরে আরও ছয়টি হলিডে স্টেশন থাকবে। এগুলো হলো বড়তলা, কালকিনি, বজরিপুর, দাপদপাই, বদরপুর ও কুকুয়া।
দৈর্ঘ্য বিবেচনায় এমন দাম কেন?
পরিকল্পনা অনুযায়ী, রেলপথের প্রতি কিলোমিটারে সার্বিক নির্মাণ ব্যয় হবে ১১৩ কোটি ১৪ লাখ ৯৯ হাজার টাকা। জমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসন বাদে প্রতি কিলোমিটার খরচ হবে ৮৯.৭০ লক্ষ ৭২ হাজার কোটি টাকা। পুরো রুট বরাবর রেললাইন, ব্রিজ, কালভার্ট, স্টেশন ও স্টেশন ভবন নির্মাণের কথা বিবেচনা করা হলে; এমন অবস্থায় প্রতি কিলোমিটারে খরচ হবে ৪৪ কোটি ১৯ লাখ ৮৭ হাজার কোটি টাকা। তবে শুধু রেললাইন ফেলতে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় হবে ৬ কোটি ৬৭ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা।
বরিশাল অঞ্চলে নিচু জমি এবং বড় নদী রয়েছে। অনেক জমি তুলতে হবে। আকাশপথে রেলপথ ও বড় সেতুও নির্মাণ করতে হবে। এসব কারণে খরচ বাড়ছে। এরপর প্রকল্পের আওতায় কালীগঙ্গা, আমতলী, অন্ধ্রমানিক, কীর্তনখোলা, পায়রাসহ মোট ১০টি নদীর ওপর ৪৬টি বড় রেলসেতু নির্মাণ করা হবে। ৪৪০টি বক্স কালভার্ট থাকবে।
প্রকল্পের সম্ভাব্যতা সমীক্ষার পরিচালক মামুনুল ইসলাম জানান, প্রথম পর্যায়ে এ রুটে দিনরাত দুটি ট্রেন চালানোর পরিকল্পনা রয়েছে। যাত্রীরা রাতে ট্রেন ধরে সকালে কুয়াকাটা পৌঁছাতে পারেন।
রিভিশন হল PDPP
প্রাক-উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (PDPP) সামগ্রিক প্রকল্প ধারণার কেন্দ্রবিন্দু। কিন্তু এটি 100% চূড়ান্ত নয়। প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট পক্ষের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে পরিবর্তন করা হয়। এখানেও রেল মন্ত্রক তহবিল পাওয়ার আগে PDPP-তে কিছু পরিবর্তন আনছে।
সম্প্রতি রেলভবনে এই প্রকল্প নিয়ে একটি সমন্বয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে বিভিন্ন মতামত নেওয়া হয়েছে। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক শামসুল হক।
শামসুল হক বলেন, মাটি নরম হওয়ায় রেলপথ নির্মাণের জন্য অনেক জায়গায় উঁচু বাঁধ নির্মাণ করতে হয়। যার কারণে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে স্থানীয়দের। পানি প্রবাহ ব্যাহত হতে পারে। তাই ওই সব জায়গায় রেলপথ তৈরি করা যায় কি না তা ভেবে দেখার সুযোগ এখনও আছে। পথটি পিলারের ওপর থাকলে দীর্ঘ বাঁধ নির্মাণ করা হবে না। নামার পথ স্বাভাবিক হবে। ফ্লাইট খরচ বাড়লেও জমি অধিগ্রহণের খরচ থাকবে না।