বিয়ের কথা ভাবলে প্রথমেই যেটা মাথায় আসে তা হল দাম। এই খরচ দাম্পত্য পোশাকের জন্য উচ্চ-শুল্ক আইটেম সীমাবদ্ধ নয়. এখন যেমন বিনোদনের খরচ বেড়েছে, তেমনি বিনোদন হল ভাড়ায় ব্যক্তিগত আয় গণনার বাধ্যবাধকতাও বেড়েছে। এখানেই শেষ নয়, সামাজিক নিরাপত্তার নামে বিয়ে করতে মোটা অঙ্কের যৌতুক নেয় আদালত।
এই যৌতুক আদায়ের পরই বিয়ে নিবন্ধন করা হয়। নিবন্ধন করতে ব্যর্থ হলে সমস্যা হতে পারে। তাই প্রায় সবাই বিয়ের যৌতুকের নির্ধারিত ফি পরিশোধ করে রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন করছে। সরকার এই ফি থেকে আয় দ্বিগুণ করতে চায়। ফলে বিয়ের সামগ্রিক খরচ চলছে।
‘এক টাকার কেবিন’ বিগত সময়ের গল্প। এটি এখনও মাঝে মাঝে ঘটে। গত জুনে ৯ টাকা যৌতুক নিয়ে বিয়ে করেন ছোট পর্দার অভিনেত্রী চমক।
তবে এ ধরনের ঘটনা সচরাচর দেখা যায় না। এখন সম্পদ ও পদমর্যাদার লড়াইয়ে বিয়ের অনুষ্ঠানে লাখ লাখ বা কোটি টাকার যৌতুক আরোপ করা হয়। সম্প্রতি দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী গ্রুপের চেয়ারম্যানের ছেলের বিয়েতে ১২ কোটি টাকা যৌতুক আরোপ করা হয়েছে। এক টাকার স্ট্যাম্পের জন্য সরকারকে 200 টাকা রেজিস্ট্রেশন ফি দিতে হবে। যেখানে কোটি টাকার ডিবেঞ্চারের জন্য ফি দিতে হয় ১৬ হাজার ৫০০ টাকা।
ইসলামি শরিয়ত বলে স্বামীর আয় থেকে স্ত্রীকে যৌতুক দিতে হবে। তবে সামর্থ্য বা না হোক, উচ্চবিত্ত ও সমাজের মধ্যে মর্যাদার লড়াইয়ের কারণে বড় ধরনের যৌতুক প্রচলিত হয়ে উঠেছে। তবে এই অর্থ প্রদান শুধুমাত্র কাগজে কলমে। ফলে যৌতুক যত বেশি হবে, সরকার তত বেশি রেজিস্ট্রেশন ফি পাবে। তাই এবারের বাজেটে এখান থেকে আয় বাড়ানোর পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার।
বিয়েতে যৌতুকের পরিমাণ দিন দিন যেমন বাড়ছে, সরকারও চাইছে তা থেকে আয় বাড়াতে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বাজেট পরিকল্পনায় আগের অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরে বিবাহ নিবন্ধন ফি থেকে আয় দ্বিগুণ করার পরিকল্পনা রয়েছে। বিবাহ নিবন্ধন ফি সরকার বা নিকাহ রেজিস্ট্রার দ্বারা লাইসেন্সপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের দ্বারা সংগ্রহ করা হয়। তিনি কাজী নামে প্রসিদ্ধ।
সরকার কর্তৃক নির্ধারিত বিবাহ নিবন্ধন ফি
সরকার প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিয়ে ও তালাক নিবন্ধনের ফি কয়েকগুণ বাড়িয়েছে। আইন মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগ সর্বশেষ ‘মুসলিম বিবাহ ও বিবাহবিচ্ছেদ নিবন্ধন (বিধি), 2009’ সংশোধন করে 21 ডিসেম্বর, 2022-এ একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে।
সংশোধিত নিয়ম অনুসারে, নিকাহ রেজিস্ট্রার এখন প্রতি 1,000 টাকা বা পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত যৌতুকের ক্ষেত্রে তার একটি অংশের জন্য 14 টাকা হারে বিবাহ নিবন্ধন ফি আদায় করেন। আগে চার লাখ টাকা পর্যন্ত যৌতুকের ক্ষেত্রে কাজী প্রতি এক হাজার টাকা যৌতুকের জন্য বা তার অংশের জন্য ১২ টাকা ৫০ পয়সা হারে বিবাহ নিবন্ধন ফি নিতে পারতেন।
নিয়ম অনুযায়ী, যৌতুকের পরিমাণ পাঁচ লাখ টাকার বেশি হলে প্রতি এক লাখ টাকা বা তার অংশের জন্য ১০০ টাকা করে বিবাহ নিবন্ধন ফি ধার্য করা হয়। যাইহোক, যৌতুকের পরিমাণ যাই হোক না কেন, ফি 200 টাকার কম হবে না। ডিভোর্স রেজিস্ট্রেশনের ফি এখন 1000 টাকা, যা আগে ছিল 500 টাকা।
জানা যায়, মুসলিম বিয়েতে যৌতুকের বিরুদ্ধে রেজিস্ট্রেশনে বিবাহ নিবন্ধক বা কাজীর সংগৃহীত অর্থের একটি বড় অংশ সরকার জমা দেওয়ার জন্য জোর দিয়েছে। নিবন্ধন ফি বাড়ানোর আগে এই আয় বাড়াতে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছিল সংসদীয় কমিটি।
বিয়ের যৌতুক ফি থেকে আয়
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনটি পাহাড়ি এলাকা ছাড়া সারা দেশে ২০ লাখ ২০ হাজার ৭৪৯টি বিয়ে হয়েছে। এসব বিয়েতে যৌতুকের পরিমাণ ৯০ হাজার ৯৪০ কোটি ৬৯ লাখ ছয় হাজার ৩৫১ টাকা। এই যৌতুকের বিনিময়ে কাজীরা আদায় করেন ১ হাজার ৫৬২ কোটি ৮ লাখ ৩৩ হাজার ৯৮৭ টাকা। এর মধ্যে সরকারি কোষাগারে জমা হয়েছে ৭ কোটি ৮৫ হাজার ৪৫৮ টাকা। সরকারের বছরে গড় আয় ২ কোটি ৬২ লাখ টাকা। আর এখন বার্ষিক যৌতুক ৩৫ হাজার কোটি টাকা।
সরকারের এই আয় দিয়ে তিন বছরে মাথাপিছু আয় প্রায় চার গুণ বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে বিবাহ নিবন্ধন ফি থেকে ৯৩৩ মিলিয়ন টাকা আয়ের পরিকল্পনা করেছে সরকার। যদিও সরকার গত অর্থবছরে বিবাহ নিবন্ধন ফি বাবদ ৪ কোটি ৬১ লাখ টাকা আয়ের প্রস্তাব করেছিল। সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে ৪ কোটি ২২ লাখ টাকা করা হয়।
যৌতুক কত?
2008 বাংলাদেশী রোমান্টিক-ড্রামা ফিল্ম ‘1 তক্কর বউ।’ এই ছবিতে এক টাকার কেবিন আছে। শুধু চলচ্চিত্রে নয়, বাস্তব জীবনের বিয়েতেও এমনটা হচ্ছে। ২০২১ সালের ৮ জানুয়ারি ফরিদপুরে এক টাকা যৌতুক নিয়ে বিপাশা নামের এক মেয়ের বিয়ে হয়। গল্পের আসল চরিত্র মাহমুদুল ইসলাম আশিক ও তানিয়া আহমেদ তন্বী। 2021 সালে মাত্র এক টাকার কাবিনে তাদের বিয়ে হয়।
2006 সালের ব্লকবাস্টার ছবি কোটি টাকাবিন। বাস্তব জীবনে এখন কোটি টাকার কেবিন আছে। রাজধানীর একটি অভিজাত এলাকায় কমিশনারের ছেলের বিয়ের যৌতুক ছিল ১০ কোটি টাকা বলে ওই এলাকার কাজী মো. এখন যাদের টাকা আছে তারা সাধারণত কোটি টাকার কম যৌতুক নেয় না বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন। মধ্যবিত্ত পরিবারের ক্ষেত্রে, বেশিরভাগ বিয়েতে খরচ হয় 2 লক্ষ থেকে 10 লক্ষ টাকার মধ্যে।
রাজধানীর বনানী এলাকার কাজী মোহাম্মদ জাকারিয়া বলেন, মূল্যস্ফীতির চাপে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো এখন বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা কমিয়ে দিচ্ছে। এতে যৌতুকের বিষয়টি প্রভাবিত হয়েছে। এখান থেকে সরকারের আয় বাড়াতে নতুন পদক্ষেপের ওপর নির্ভর করবে।
রাজধানীর শাহবাগ এলাকার কাজী মোহাম্মদ আবদুল মোতালেব বলেন, ঢাকা মহানগরীতে অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর বিয়ের সংখ্যা বাড়েনি। তবে সরকার সারা দেশে জরিপ চালায়। সেই ভিত্তিতেই সম্ভবত বিয়ের ফি থেকে আয় বাড়ানোর ওপর জোর দিচ্ছেন তারা। তিনি বলেন, বর-কনের যৌতুকের ওপর বিয়ের ফি’র পরিমাণ নির্ভর করে। আর এর ওপর নির্ভর করবে ফি থেকে আয়।
বিয়ের ওপর মুদ্রাস্ফীতির চাপ
বিয়েতে মুদ্রাস্ফীতির চাপ রয়েছে। একদিকে বেড়েছে কেনাকাটার খরচ, অন্যদিকে বেড়েছে বিনোদনের খরচও। এই ব্যয় বৃদ্ধির কারণে সাম্প্রতিক সময়ে মধ্যবিত্ত পরিবারে সীমিত পরিসরে বিয়ের আয়োজন করা হচ্ছে। মুদ্রাস্ফীতির চাপে অনেকেই ঘরে বসেই বিয়ে করছেন। এমন তথ্য জানিয়েছেন রাজধানীর বিভিন্ন কমিউনিটি সেন্টার, রেস্তোরাঁ ও পার্টি সেন্টারের মালিক ও ব্যবস্থাপকরা।
রাজধানীর খিলগাঁওয়ে অবস্থিত একটি পার্টি সেন্টারের ব্যবস্থাপক আবুল বাশার জানান, ঈদের আগে ও পরে বিয়ের পার্টির বুকিং এক থেকে দেড় মাস আগে থেকে করা হতো। এবারও হাতেগোনা কয়েকটি দল হয়েছে। এবার ঈদের পর কোনো বুকিং হয়নি। মুদ্রাস্ফীতির কারণে ঘটনার সংখ্যা কমছে। এই মূল্যস্ফীতির বাজারে অনেকেই বিয়ের খরচ মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন। এমনও হয়েছে যে দু-চারটি বুকিং বাতিল করা হয়েছে এবং খরচ মেটাতে গৃহস্থালির ব্যবস্থা করতে হয়েছে।
বাজেটে বাড়ছে বিয়ের খরচ
শহুরে এলাকায় বিবাহ হল কমিউনিটি সেন্টার। আর এখন থেকে বিয়ের জন্য কমিউনিটি সেন্টার বা পার্টি সেন্টার ভাড়া নিতে আয়কর রিটার্ন জমার রশিদ লাগবে। অর্থাৎ বিয়ের প্রস্তুতিতে যোগ হচ্ছে নতুন নতুন খরচ। এখন থেকে বার্ষিক আয়কর রিটার্ন দাখিলের রশিদ ছাড়া মিলনায়তন ভাড়া নেওয়া যাবে না। বর্তমানে 43 ধরনের পরিষেবার জন্য ফেরত আমানতের একটি অনুলিপি প্রয়োজন। এ তালিকায় অডিটোরিয়াম ভাড়ার জন্য রিটার্ন দাখিলের বাধ্যবাধকতা চলতি অর্থবছরের বাজেটে যুক্ত করা হয়েছে। তবে চলতি অর্থবছরে করমুক্ত আয়ু বাড়েনি। এখন বার্ষিক করমুক্ত জীবনসীমা মাত্র সাড়ে তিন লাখ টাকা।
গত অর্থবছরে বিয়ের খরচও বেড়েছে। বিয়ের প্রসাধনীতে শুল্ক বাড়ানো হয়েছে ১৭ শতাংশ। বিদেশী প্রসাধনী পণ্যের আমদানি শুল্ক ৩ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২০ শতাংশ; চলতি অর্থ বছরে এই টাকা পরিশোধ করতে হবে।