আগামীকাল ড. ইউনূসের সঙ্গে মতবিনিময় করেন হেফাজত ইসলাম ও ছয়টি ইসলামী রাজনৈতিক দল- চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, নেজামে ইসলাম ও খেলাফত আন্দোলন। এছাড়া আলোচনায় অংশ নেয় এলডিপি, জাতীয়তাবাদী সম্মান জোট, বাংলাদেশ জাসদ, ১২ দলীয় জোট ও গণফোরাম। মতবিনিময়কালে প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পন্ন করে নির্বাচনের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে সময় দিতে সব দল একমত হয়েছে।
বিকাল ৩টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শেষে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, সংবিধান পুনর্লিখন হবে নাকি সংশোধন করা হবে সে বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করেছেন। প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে বাংলাদেশ কেমন হবে তার রূপরেখা শিগগিরই ঘোষণা করবে অন্তর্বর্তী সরকার।
পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল চাই: জাপা সাধারণ সম্পাদক চুন্নু
সন্ধ্যা সাতটায় জাপা সভাপতি জিএম কাদেরের নেতৃত্বে দলের প্রধান উপদেষ্টার পাঁচ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল সেখানে পৌঁছায়। ইউনূসের সঙ্গে কথা হয়। প্রতিনিধিদলের অন্যদের মধ্যে ছিলেন দলের সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, সাধারণ সম্পাদক মুজিবুল হক চুন্নু এবং প্রেসিডিয়াম সদস্য মনিরুল ইসলাম মিলন ও মাশরুর মাওলা। প্রায় সোয়া ঘণ্টাব্যাপী মতবিনিময় শেষে জাপা সাধারণ সম্পাদক মুজিবুল হক চুন্নু উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, মতবিনিময়কালে তার দলের সভাপতি জিএম কাদের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিলের প্রস্তাব করেন।
মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, তিনি বিচার বিভাগ ও সংসদের মধ্যে ভারসাম্য আনার কথা বলেছেন। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য সৃষ্টির কথা বলেছেন ড. তিনি এমন সংস্কারের প্রস্তাব করেছিলেন যে একজন ব্যক্তি দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী পদে থাকতে পারবেন না। তিনি আরও বলেন, একজন সংসদ নেতার প্রধানমন্ত্রী হওয়া উচিত নয়। এ ছাড়া বিচার বিভাগ, প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন ও পুলিশসহ বিভিন্ন খাতে প্রয়োজনীয় সংস্কার করে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টির জন্য যথাসম্ভব সময় দিতে হবে; জাপা মতবিনিময় সভায় জানায়, সে পর্যন্ত ইএসআরকারকে সময় দিতে প্রস্তুত।
এক প্রশ্নের জবাবে জাপা সাধারণ সম্পাদক বলেন, বিগত নির্বাচনে জাপা বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে অংশ নিয়েছে। এ পর্যন্ত সব নির্বাচনে অংশ নিয়েছে জাপা। আমরাও ক্ষমতায় ছিলাম। আমরাও ভুল করি। প্রত্যেকেরই ভুল আছে। আমি প্রয়োজনীয় উন্নতির কথা বলেছি যাতে আমরা আবার একই ভুল না করি। কারণ আমরা বিশ্বাস করি, ক্ষমতায় আসার পর রাজনৈতিক দলগুলো যে সংস্কার করতে পারবে না, বর্তমান সরকার তা করতে পারবে-এটা আমরা বিশ্বাস করি।
একজন ব্যক্তি দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না: হেফাজত ইসলামসহ ৬টি ইসলামী দল
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হেফাজত ইসলাম ও ছয় ইসলামী দলের নেতারা। মোহাম্মদ ইউনুসের সঙ্গে দেখা করেন। বৈঠকে তিনি প্রস্তাব করেন, কোনো ব্যক্তি দুই মেয়াদের বেশি দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন না। এ ছাড়া তিনি সংস্কারকে যুক্তিসঙ্গত সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করার এবং জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের আহ্বান জানান। বৈঠক শেষে হেফাজতে ইসলামের নেতা ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের সাধারণ সম্পাদক মাওলানা মামুনুল হক সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান।
মামুনুল হক বলেন, সংস্কার ও উপযুক্ত সময়ে নির্বাচনের কথা বলেছেন। তিনি বলেন, নির্বাচনে অযথা বিলম্ব করা চলবে না। ইসলামী দলগুলোর প্রস্তাবে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্মত হন এবং প্রয়োজনীয় সংস্কারের পর কোনো বিলম্ব না করে নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন।
যৌক্তিক সময় কত দিন এমন প্রশ্নের জবাবে মামুনুল হক বলেন, যৌক্তিক সময় নিয়ে আমাদের পক্ষ থেকে কোনো প্রস্তাব দেওয়া হয়নি। আমরা কোন নির্দিষ্ট Meyongad আলোচনা না. প্রতিটি দলই প্রধান উপদেষ্টার কাছে সংস্কার প্রস্তাব জমা দিয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, মূল প্রস্তাবগুলোর মধ্যে একটি ছিল নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার। তিনি বলেন, “জাতীয় সংসদে সকল ভোটারের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার জন্য আমরা এই ধরনের মৌলিক সংস্কারের প্রস্তাব করেছি।”
মামুনুল হক বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করতে এবং স্বৈরাচারের উৎপত্তিস্থলে ভারসাম্য সৃষ্টির জন্য একটি ব্যবস্থার প্রস্তাব করা হয়েছে।
মামুনুল হক বলেন, হেফাজত ইসলামের বিভিন্ন আন্দোলনে অনেক মামলা হয়েছে এবং শত শত মানুষ আহত হয়েছে, অনেকে নিখোঁজ রয়েছে, তাদের সন্ধানে সহায়তা চাওয়া হয়েছে। সকল হত্যার দ্রুত বিচার নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনে ট্রাইব্যুনাল গঠন করা। দায়ী ব্যক্তিদের, যারা এই নির্দেশ দিয়েছেন তাদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানান তিনি। তিনি বলেন, আমরা প্রস্তাব করেছি যে, ইসলামবিরোধী কোনো আইন করা হবে না। এছাড়াও, আমরা নির্বাহী আদেশ বা আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হেফাজতে ইসলামের মামলা প্রত্যাহারের জন্য এক মাসের সময়সীমা চেয়েছি।
ইসলামী আন্দোলন সংবিধান পুনর্লিখনের দাবি জানায়
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম পীর সাহেব চরমোনাইর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে অংশ নেন। কিয়া পার্টি জুলাইয়ের গণহত্যার শুনানির জন্য একটি গ্রহণযোগ্য তদন্ত কমিশন এবং একটি স্বাধীন ট্রাইব্যুনাল গঠন সহ ১৩ দফা প্রস্তাব করেছে। প্রতিনিধিদলের অন্য সদস্যরা হলেন মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করিম, প্রিন্সিপাল হাফেজ মাওলানা ইউনুস আহমদ, মাওলানা গাজী আতাউর রহমান ও ইঞ্জিনিয়ার মুহাম্মদ আশরাফুল আলম।
ইসলামী আন্দোলনের মতে, যেহেতু বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জনগণের বিপ্লবের মাধ্যমে জনগণের ইচ্ছায় গঠিত হয়েছে এবং এই সরকারের পক্ষে রাজনৈতিক ঐকমত্য রয়েছে; তাই দেশ ও এর রাজনীতিকে সঠিক পথে আনার বিশাল সুযোগ তৈরি হয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশের স্বার্থে প্রয়োজনীয় সংস্কার না করলে হাজার হাজার শিক্ষার্থীর রক্তদান ব্যর্থ হবে বলে মনে করে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ।
ইসলামী আন্দোলনের প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে বিদ্যমান সংবিধান বাতিল এবং একটি সাংবিধানিক কমিশন গঠন করে নতুন সংবিধান প্রণয়ন এবং গণভোটের মাধ্যমে অনুমোদন করা; গত 16 বছরে পরিচালিত সমস্ত রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক গণহত্যা, গণহত্যা, গুম এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচার করা এবং রাজনীতি ও নির্বাচন থেকে দোষী ব্যক্তি বা সংস্থাকে নিষিদ্ধ করা; তদন্ত সাপেক্ষে সমস্ত দুর্নীতিবাজ এবং বিদেশী অর্থপাচারকারীদের সমস্ত সম্পদ জব্দ করা এবং রাষ্ট্রের কোষাগারে জমা করা; কালো টাকা ফেরত আনার উদ্যোগ নেওয়া; অবৈধ ও হাস্যকর নির্বাচনে সহযোগিতাকারী ৩ নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।
উত্তরকে ‘মুগধনগর’ করার দাবি ১২ দলের জোটের
বৈঠক শেষে বিএনপির মিত্র ১২ দলীয় ঐক্যজোটের মুখপাত্র শাহাদাত হোসেন সেলিম সাংবাদিকদের বলেন, আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করে শহীদ আবু সাইয়িদ রাখার কথা বলেছি। আমি মাধের স্মরণে উত্তর মাধনগর নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছি। আমরা আশা প্রকাশ করেছি, চট্টগ্রাম বন্দর টার্মিনাল যেন বিদেশীদের হাতে না দেওয়া হয়। জাপার বৈঠকে আমন্ত্রণ জানানোর সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘এই জিএম কারও গাঙে প্রতারণা করে গণতন্ত্রকে হত্যা করেছে।’ বৈঠকে নেতৃত্ব দেন ১২ দলীয় জোটের প্রধান মোস্তফা জামাল হায়দার।
প্রসঙ্গত, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল-জোটের মতবিনিময়ের দ্বিতীয় পর্ব এটি। প্রথম দফায় বিএনপি-জামায়াতসহ বিভিন্ন দলের নেতারা বৈঠক করেন। তবে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ বা ১৪ দলীয় জোটের কাউকে এখনো বৈঠকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।