বাংলাদেশের ছাত্র বিপ্লবের গল্প বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ছাত্র বিপ্লবে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর নতুন বাংলাদেশের সঙ্গে পুনরায় সংযোগ স্থাপনের জন্য তিনি বিশ্ববাসীর প্রতি আহ্বান জানান। উপরন্তু, তিনি গাজায় অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছেন।
শুক্রবার (২৭ সেপ্টেম্বর) বাংলায় জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনে প্রধান উপদেষ্টা তার নজিরবিহীন বক্তব্যে এসব বিষয় তুলে ধরেন। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রেক্ষাপট এবং বাংলাদেশের ছাত্র বিদ্রোহের বীরত্বগাথা তুলে ধরে তিনি বলেন, বাংলাদেশের এই ‘বিদ্রোহ’ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষকে আগামী দিনে স্বাধীনতা ও ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াতে উদ্বুদ্ধ করবে। অনুপ্রাণিত করবে। দিন। নিউইয়র্কে স্থানীয় সময় সকাল ১০টায় জাতিসংঘ সদর দফতরের সাধারণ পরিষদ হলে দেওয়া বক্তৃতায় তিনি তুলে ধরেন কিভাবে বাংলাদেশি ছাত্ররা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে এবং সফল অভ্যুত্থান ঘটিয়ে জনগণের মধ্যে নতুন স্বপ্নের বীজ বপন করেছে।
ছাত্রদের নেতৃত্বে বাংলাদেশে জুলাই-আগস্টে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল তার দিকে ইঙ্গিত করে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘এই ঘটনার কারণেই আজ আমি বিশ্ব সম্প্রদায়ের এই মহান সংসদে যোগ দিতে পেরেছি। আমাদের জনগণের অপার শক্তি, বিশেষ করে তরুণদের, আমাদের বিদ্যমান রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও প্রতিষ্ঠানের আমূল পরিবর্তনের এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে।
ছাত্র বিদ্রোহের প্রেক্ষাপটে আলোকপাত করে তিনি আরও বলেন, ছাত্র ও যুব সমাজের আন্দোলন ছিল মূলত একটি বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন। ধীরে ধীরে তা গণআন্দোলনে পরিণত হয়। তখন সারা বিশ্ব বিস্ময়ের সাথে দেখেছে যে, বাংলাদেশের সমগ্র জনগণ কিভাবে স্বৈরাচার, নিপীড়ন, বৈষম্য, অন্যায় ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে রাজপথে এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশের তরুণদের প্রজ্ঞা, সাহস ও প্রত্যয় দেখে আমরা অভিভূত হয়েছি নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূস বলেন, গুলির শব্দ উপেক্ষা করে আমাদের এই যুবকরা তাদের কাণ্ড সংগ্রহ করতে উঠে দাঁড়ায়। মেয়েরা বেআইনি সরকারের বিরুদ্ধে জোরালো আওয়াজ তুলেছে। স্কুলপড়ুয়া কিশোররা বিনা দ্বিধায় তাদের জীবন উৎসর্গ করেছে। চিরতরে দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন শত শত মানুষ।
তিনি বলেন, আমাদের মায়েরা, দিনমজুর এবং শহরের অগণিত মানুষ রাস্তায় তাদের সন্তানদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেন। প্রখর রোদ, বৃষ্টি ও মৃত্যুভয় নির্বিশেষে সত্য ও ধর্মীয় আশা-আকাঙ্খার বিপরীতে দীর্ঘদিন রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনার অশুভ ষড়যন্ত্রকে জয় করেন। আমাদের তথ্য অনুযায়ী, এই গণআন্দোলনে স্বৈরাচারী শক্তির হাতে আমরা ৮ শতাধিক প্রাণ হারিয়েছি।
নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, শিক্ষার্থীদের অদম্য সংকল্প ও প্রত্যয় আমাদের স্বৈরাচারী ও অগণতান্ত্রিক শাসন থেকে মুক্তি দিয়েছে। তিনি আশা প্রকাশ করেন যে তাদের সম্মিলিত দৃঢ়তার মাধ্যমে বাংলাদেশ বিশ্ব সম্প্রদায়ে একটি দায়িত্বশীল জাতির মর্যাদা অর্জন করবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বলেন, উদারনীতি, বহুত্ববাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি জনগণের গভীর আস্থার কারণেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উন্নয়ন হয়েছে। 1971 সালে আমাদের জনগণ যে মূল্যবোধের জন্য লড়াই করেছিল তা আমাদের বহু বছর পর জেনারেশন জিকে নতুন করে দেখতে শিখিয়েছে। এটা আমরা দেখেছি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে যখন বাংলা মাতৃভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের তরুণরা প্রমাণ করেছে যে, জনগণের স্বাধীনতা, মর্যাদা ও অধিকার সমুন্নত রাখার অভিপ্রায় কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষা নয়; বরং, এটি অবশ্যই সবার জন্য মূল্যবান।
তিনি তার ভাষণে বিশ্ববাসীকে বাংলাদেশের নতুন যাত্রায় অংশগ্রহণের আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘আমাদের ছাত্ররা তাদের অদম্য দৃঢ়তা ও দৃঢ় বিশ্বাসের মাধ্যমে একটি স্বৈরাচারী ও অগণতান্ত্রিক শাসন থেকে আমাদের মুক্তি দিয়েছে। আমি বিশ্ব সম্প্রদায়কে আমাদের মুক্তি ও গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা উপলব্ধি করতে আমাদের নতুন বাংলাদেশের সাথে পুনরায় সম্পৃক্ত হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।
অধ্যাপক ইউনূস গণতন্ত্র, আইনের শাসন, সাম্য ও সমৃদ্ধি অর্জনের মাধ্যমে একটি ন্যায়সঙ্গত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতান্ত্রিক সমাজ হিসেবে আত্মপ্রকাশের অভিপ্রায় বাস্তবায়নে বাংলাদেশের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বর্ধিত সমর্থন ও সহযোগিতার আহ্বান জানান।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ প্রসঙ্গে নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক ইউনূস বলেন, আমাদের যুবসমাজ এবং দেশের বিশাল অংশ সম্মত হয়েছে এবং রাষ্ট্রের জরাজীর্ণ কাঠামো পুনর্গঠনের দায়িত্ব আমাকে ও আমার উপদেষ্টা পরিষদের ওপর অর্পণ করেছে সরকার পরিচালনার বিশাল দায়িত্ব।
“পদ গ্রহণ করার পর, আমরা গভীর আশ্চর্য এবং হতাশার সাথে দেখছি যে কীভাবে ব্যাপক দুর্নীতি একটি কার্যকরী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলিকে নির্মম পক্ষপাতিত্বের চক্রে আটকে রেখেছে,” তিনি বলেন, কীভাবে জনগণের সম্পদ নির্মমভাবে নষ্ট করা হয়েছে৷ লুণ্ঠন ও লুটপাট, কিভাবে একটি বিশেষ স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী অবৈধভাবে সমস্ত ব্যবসা দখল করেছে এবং প্রকাশ্যে দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করেছে। মোটকথা, ন্যায়বিচার, নৈতিকতা ও নৈতিকতা সর্বস্তরে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, এমন পরিস্থিতিতে দেশ পুনর্গঠন ও জনগণের কাঙ্খিত শাসনব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব আমাদের ওপর ন্যস্ত হয়েছে। এই মুহুর্তে, আমাদের মূল লক্ষ্য অতীতের ভুলগুলি সংশোধন করা এবং একটি প্রতিযোগিতামূলক এবং শক্তিশালী অর্থনীতি এবং একটি ন্যায়সঙ্গত সমাজ গড়ে তোলা।
ড. ইউনূস তার বক্তব্যে বলেন, বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সব রাজনৈতিক দলই এখন তাদের মতামত প্রকাশ্যে প্রকাশ করতে পারছে। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, জনগণের মৌলিক অধিকার রক্ষা ও রক্ষায় আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ। আমাদের দেশের মানুষ নির্ভয়ে কথা বলবে, সমাবেশ করবে, ভোট দেবে এবং তাদের পছন্দের মানুষকে নির্বাচিত করবে- এটাই আমাদের লক্ষ্য। আমরা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বজায় রাখতে এবং সাইবার ডোমেইন সহ মিডিয়ার স্বাধীনতাকে শক্তিশালী করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
জাতিসংঘসহ বহুপাক্ষিক বৈশ্বিক কাঠামোতে বাংলাদেশের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও অবদান অব্যাহত থাকবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আমাদের সরকার আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক ও দ্বিপাক্ষিক চুক্তিগুলোকে সমুন্নত রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যার বাংলাদেশ একটি পক্ষ।”
বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশ পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সম্মান ও স্বার্থ রক্ষার ভিত্তিতে বিশ্বের সব দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে আগ্রহী।
দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, মাত্র সাত সপ্তাহে আমাদের সরকার অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে।
গাজায় অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান: ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে চলমান নৃশংসতা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে, গাজায় মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আজকের বহুমুখী সংকটে যুদ্ধ ও সংঘাতের ফলে মানবাধিকার ব্যাপক হারে ক্ষুণ্ন হচ্ছে।
তিনি বলেন, বিশ্বের উদ্বেগ ও নিন্দা সত্ত্বেও গাজায় গণহত্যা থামছে না। ফিলিস্তিনের বর্তমান বাস্তবতা শুধু আরব বা মুসলমানদের উদ্বেগের বিষয় নয়; বরং সমগ্র মানব জাতির জন্যই চিন্তার বিষয়।
অধ্যাপক ইউনেস বলেন, একজন মানুষ হিসেবে প্রতিটি ফিলিস্তিনির জীবন অমূল্য। ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে জবাবদিহি করতে হবে।
যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ফিলিস্তিনের জনগণ বিশেষ করে নারী ও শিশুদের ওপর চলমান নৃশংসতা থেকে মুক্তি পেতে বাংলাদেশ অবিলম্বে সম্পূর্ণ যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানাচ্ছে।
দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধান মধ্যপ্রাচ্যে স্থায়ী শান্তি আনতে পারে, তাই এটি বাস্তবায়নের জন্য এখনই উদ্যোগ নিতে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান অধ্যাপক ইউনূস।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বিষয়ে আলোকপাত করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আড়াই বছর ধরে ইউক্রেনে যে যুদ্ধ চলছে তাতে বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। এই যুদ্ধের প্রভাব সর্বজনীন। এর প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও। তাই আমরা উভয় পক্ষকে আলোচনার মাধ্যমে সংঘাতের সমাধান এবং যুদ্ধের অবসানের আহ্বান জানাই।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য আন্তর্জাতিক সমর্থন অব্যাহত রাখার আহ্বান: প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস মিয়ানমারের রোহিঙ্গা বেসামরিক, জাতিগত নির্মূলের শিকার, তাদের স্বদেশে স্থায়ী প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করতে পর্যাপ্ত সহায়তা অব্যাহত রাখার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
“আমরা মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে সহায়তা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ,” প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমরা রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক সহায়তা কার্যক্রম চালিয়ে যেতে এবং তাদের স্থায়ী প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে পর্যাপ্ত সমর্থন চাইছি।
রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের আহ্বান জানিয়ে অধ্যাপক ইউনূস রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য আন্তর্জাতিক বিচার আদালত এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে চলমান বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে স্বাধীন ও মর্যাদাপূর্ণ জীবন যাপনের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিতে জাতিসংঘসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর অব্যাহত প্রচেষ্টা প্রশংসার দাবি রাখে। এ লক্ষ্যে রোহিঙ্গাদের পর্যাপ্ত সুরক্ষা ও অধিকার দিয়ে তাদের মাতৃভূমি রাখাইনে ফেরার পথ সুগম করা প্রয়োজন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ সাত বছর ধরে মানবিক কারণে মিয়ানমার থেকে আসা ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে আসছে। ফলে আমরা ব্যাপক আর্থ-সামাজিক-পরিবেশগত ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছি। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সমস্যা থেকে উদ্ভূত এই সংকট বাংলাদেশ এবং আমাদের অঞ্চলের জন্য ঐতিহ্যগত এবং অপ্রচলিত উভয় ধরনের নিরাপত্তা হুমকির উৎস হয়ে উঠেছে।