বন্ধু
মন্তিউর: ‘আমি তোমাকে চাই, তুমি আমাকে কবে দিতে পারবে?
আরজিনাঃ আজ…!
মন্তিউর: আজকের অনুষ্ঠান ঠিক আছে?
আরজিনাঃ আজ… কাল যাব। এটা শুক্রবার, মানে আমি বাইরে যাচ্ছি, কাউকে খুঁজে পাচ্ছি না। তুমি কি বাড়িতে? আগামীকাল আরও ভালো। আগামীকাল ঢাকায় থাকবেন।
মন্তিউর: আহ… ঠিক আছে। আমি মনে করি না আমি আগামীকাল এটি করতে সক্ষম হব।
আরজিনা: যদি তুমি কষ্টে থাকো… মানে আজ শুক্রবার, আমি কাউকে খুঁজে পাচ্ছি না। আমি বাইরে থাকব, ইয়া মাইন্ড…অর্থাৎ যদি কোন সন্দেহ হয়।
মন্তিউর: তাহলে আহ… ঠিক আছে।
উল্লেখিত বাক্যগুলো কোনো নাটক বা চলচ্চিত্রের সংলাপ নয়। ছাগল মামলায় সম্প্রতি খবরে থাকা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক সদস্য মতিউর রহমান এবং তার অধস্তন নারী কর্মকর্তা আরজিনা খাতুনের মধ্যে মোবাইল ফোনে কথোপকথনের এই মর্মান্তিক অডিও রেকর্ডের পর তোলপাড় শুরু হয়েছে। ফাঁস , মতিউর রহমানের বান্ধবী হিসেবে অনেক অনৈতিক সুবিধা পেয়েছেন আরজিনা। অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থ দিয়ে তিনি অনেক সম্পত্তির মালিক হয়েছেন। তিনি ঢাকায় অভিজাত অ্যাপার্টমেন্ট, গ্রামে বিলাসবহুল বাড়ি, 500 পিস স্বর্ণালঙ্কার সহ বিপুল সম্পদ অর্জন করেছেন। আরজিনার দুর্নীতি ও অর্জিত সম্পদের অভিযোগ দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) পৌঁছেছে।
এদিকে নতুন কর্মস্থলে যোগদান না করে আত্মগোপনে থাকা মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে এখনো কোনো ব্যবস্থা নেয়নি অর্থ মন্ত্রণালয়। তবে রোববার দুদকের আবেদনের আলোকে মতিউর পরিবারকে ১ হাজার ১৯ শতাংশ জমি ও চারটি ফ্ল্যাট দেওয়ার নির্দেশ দেন আদালত। বৃহস্পতিবার ঢাকা মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ মোহাম্মদ আসমাছ জগলুল হোসেন এ আদেশ দেন। উল্লেখ্য, মতিউর রহমানের সম্পর্কের নানা অনৈতিক সুবিধা নিয়ে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছিলেন এনবিআরের আর্জিনা খাতুন।
রাজধানীতে বিলাসবহুল ইন্টেরিয়রসহ ফ্ল্যাট, গ্রামে বিলাসবহুল বাড়ি, পরিবারের সদস্যদের নামে জমিসহ বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন তিনি। মাত্র 3 বছরে অন্তত 500 পিস সোনার গয়না কিনেছেন আর্জিনা। এর মধ্যে ২০০ লোড বিদেশ থেকে চোরাচালানের মাধ্যমে আনা হয়েছে বলে দুদকে অভিযোগ করা হয়েছে। আরজিনা খাতুন বর্তমানে রাজস্ব বোর্ডের মনিটরিং, পরিসংখ্যান ও সমন্বয় বিভাগের দ্বিতীয় সচিব। এর আগে তিনি চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের জেলা প্রশাসক ছিলেন।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, গত ১০ জুন এক ব্যক্তি আরজিনার দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদের তথ্য প্রকাশ করে দুদকে অভিযোগ জমা দেন। বলা হয়, মিথ্যা তথ্য দিয়ে পণ্য আমদানি, মানি লন্ডারিং, স্বর্ণ চোরাচালান চক্রের সঙ্গে যোগসাজশ এবং সম্প্রতি খবরে আসা এনবিআরের সাবেক সদস্য মতিউর রহমানের সংস্পর্শে এসে দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল সম্পদ অর্জন করেন আরজিনা।
দুদকে জমা দেওয়া অভিযোগের ভিত্তিতে রাজধানীর মিরপুরে প্রায় দুই হাজার বর্গফুটের বিলাসবহুল ফ্ল্যাট রয়েছে বলে জানা গেছে। ১ কোটি ৩০ লাখ টাকায় কেনা একটি ফ্ল্যাটে পরিবার নিয়ে থাকেন তিনি। কিন্তু রেজিস্ট্রেশন ডকুমেন্টে ফ্ল্যাটের দাম দেখানো হয়েছে মাত্র ৬৮ লাখ টাকা। ফ্ল্যাট কেনার জন্য ২০২০ সালে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তদন্তে জানা যায়, তিনি ঋণ নেওয়ার এক বছর আগে ফ্ল্যাটটি কিনেছিলেন এবং নিবন্ধনও করেছিলেন। তাও ঋণের দ্বিগুণ। বাড়িটিকে বিলাসবহুল আসবাবপত্র এবং আধুনিক অভ্যন্তর দিয়ে সজ্জিত করতে তিনি প্রায় 50 লক্ষ টাকা খরচ করেছেন। আরজিনার গ্রামের বাড়ি রাজবাড়ীর নাড়োয়া ইউনিয়নের তালুতপাড়া গ্রামে। কাস্টমসে কাজ করার ৩ বছরের মধ্যে আলিশান গ্রামের টিনের ঘরটিকে একটি সুন্দর ভবনে রূপান্তরিত করে।
দুদকে দাখিল করা অভিযোগে বলা হয়েছে, চট্টগ্রামে বদলির পর ২০২২ সালে গ্রামে পরিবারের সদস্যদের নামে ৫টি জমি ক্রয় করেন। যার বাজার মূল্য পাঁচ লাখ টাকা। সেসব জমির দলিলও পাওয়া গেছে। এছাড়া গ্রামে প্রায় এক কোটি টাকার জমি ও বন্ধক নিয়েছেন আরজিনা। তার কাছের লোকজন জানান, আরজিনার ব্যবহৃত বেশিরভাগ গহনা খুবই দামি। তার কাছে অন্তত ১০ লাখ টাকার হীরার গয়না রয়েছে।
2018 থেকে 2023 সালের মধ্যে, তিনি নগদে কমপক্ষে 500 পিস সোনা এবং হীরার গয়না কিনেছিলেন। সিএন্ডএফ মার্চেন্টের মাধ্যমে ৩ দফায় ২০০টি কার্গো পাচার হওয়ার তথ্য ও প্রামাণ্য প্রমাণ দুদকের কাছে অভিযোগের সঙ্গে দাখিল করা হয়েছে। তিনি 2022 সাল থেকে শেয়ার ব্যবসাও করেছেন। দিনে 10 লাখ টাকা বিনিয়োগ করে দ্বিগুণ মুনাফা অর্জনের উদাহরণও রয়েছে তার। তার তিনটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে বিপুল পরিমাণ নগদ এবং সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ রয়েছে।
মতিউর রহমানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের পর আরজিনা ‘আলাদিনের মোমবাতি’ পান বলে অভিযোগ রয়েছে। তার সম্পদ বাড়তে থাকে। মতিউরের সঙ্গে একই ব্রোকারেজ হাউসে শেয়ার ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছিলেন আরজিনা। শেয়ারবাজার কারসাজির মাধ্যমে মতিউর আরজিনাকে মুনাফা দেন বলে অভিযোগ রয়েছে। মতিউর-আর্গিনার মোবাইল ফোনের কথোপকথনের অডিও রেকর্ড পেয়েছেন এই প্রতিবেদক। তাদের মধ্যে কিছু অশালীন কথাবার্তারও ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে আর্জিনা খাতুন বলেন, ‘আমি আসলে যন্ত্রের শিকার। আমার প্রাক্তন স্বামী একটি মামলা করেছেন, আমি একটি মামলা করেছি। সামগ্রিকভাবে আমি সত্যিই বিরক্ত. আমি তাকে তালাক দিয়েছি, সেজন্য রাগ করে এমন কাজ করছে। পারিবারিক বিরোধের জেরে একটি মহল এ ষড়যন্ত্র করছে।
এদিকে দুদকের আইনজীবী মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর বলেন, উপ-পরিচালক মো. আনোয়ার হোসেনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মতিউরের বিপুল সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। এসব সম্পত্তির মধ্যে রয়েছে বরিশালের মুলদী উপজেলায় মতিউরের নামে ১১৪ শতাংশ জমি, নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলার মার্গাল ইউনিয়নে ২৬টি সম্পত্তির মধ্যে ৫২২ দশমিক ৫২ শতাংশ জমি তার প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজের নামে এবং একটি ২৪৪৫ বর্গফুটের ফ্ল্যাট। ব্লক। রাজধানীর বসুন্ধরায়।
১৯টি নথিতে মতিউরের ছেলে আহমেদ তৌফিকুর রহমান অর্ণবের নামে ২৭৫ দশমিক ৮৫ শতাংশ জমি রয়েছে। নরসিংদীর রায়পুরায় মতিউর-লায়লা দম্পতির মেয়ে ফারজানা রহমান ইপসিতা ঢাকার বসুন্ধরার ডি ব্লকের একটি সড়কে 5 কাতা জমিতে 106.56 শতাংশ জমির মালিক এবং এছাড়াও একটি বহুতল ভবন রয়েছে। মতিউরের দ্বিতীয় স্ত্রী শাম্মী আক্তার শিবলীর নামে ধানমন্ডির জিগতলায় একটি প্লট এবং বসুন্ধরার এন ব্লকে ৫ কাট্টা জমি রয়েছে।
দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২৪ জুন ঢাকার সিনিয়র স্পেশাল জজ মোহাম্মদ আসমাছ জগলুল হোসেন মতিউর রহমান, তার স্ত্রী লায়লা কানিজ ও ছেলে আহমেদ তৌফিকুর রহমান অর্ণবকে (ইফাত) বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা দেন। তবে গত ৩০ জুন লায়লা কানিজ তার বিদেশ সফর বাতিলের জন্য আদালতে আবেদন করেন। আগামী ২৮ জুলাই এ বিষয়ে শুনানির দিন ধার্য রয়েছে আদালতে। ঈদুল আজহার আগে ছাগলের ঘটনা আলোচিত হলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য মো. মতিউর রহমান পরিবারের অনেক কেলেঙ্কারি ও বিপুল অবৈধ সম্পদের তথ্য প্রকাশ্যে আসতে থাকে।